ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা। কেমন হবে আগামীর বাংলাদেশ তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। আগামীতে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় এগিয়ে নিতে কী কী সংস্কার প্রয়োজন তা নিয়ে কথা বলছেন বিশিষ্টজনরাও। রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি সংবিধান সংশোধনের আলোচনা এখন তুঙ্গে। কেউ বলছেন- সংবিধান পুনর্লিখনের কথা। কেউ বলছেন প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা। এসব বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তবে সরকার বলছে সংবিধান সংশোধন নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি; আলোচনা চলছে।
সংবিধান সংশোধন নিয়ে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। এ ছাড়া সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে ছাত্র-জনতার মতামত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা যায় কি না, তা নিয়েও আলোচনা চলছে। তবে আলোচনা যাই-হোক, মতামত নেওয়া হবে সমন্বয়কদের। তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, দাবিটি আসতে হবে ছাত্র-জনতার কাছ থেকে। তারা কী চায়, তারা কি নতুন কিছু চায়, নাকি পুরনো সংবিধানকে সংস্কার চায়? এটা তাদের কাছ থেকে আসতে হবে। সমন্বয়কারীরা এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেবেন।
সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, বর্তমান সংবিধান ১৯৭১ এর পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল। গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংস্কার প্রয়োজন। যে আইন ছিল শাসক শ্রেণির শোষণের জন্য সেই আইন এখনো কীভাবে বিদ্যমান থাকে? আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসনকে যদি কিনে ফেলা যায়, তাহলে গণতন্ত্র কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। তবে সংবিধান বাতিলের মধ্যে গেলে, দশ-বিশ বছর পরে তা আবারও বাতিল হবে। সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে জানতে চাইলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সংবিধানে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। সংবিধানের পরিবর্তন আমরা দুভাবে আনতে পারি। প্রথমত- পুরো সংবিধান বাদ দিয়ে আমরা নতুন করে সংবিধান রচনা করতে পারি। দ্বিতীয়ত- সংবিধানের কতগুলো বিষয়ে সুদূরপ্রসারী গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারি।
সুজন সম্পাদক বলেন, সংবিধানে কতগুলো পরিবর্তন আনা দরকার। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল রাজনৈতিক সমঝোতার প্রতিফলন। আওয়ামী লীগ দাবি করেছে, গণআন্দোলন গড়ে তুলেছে। বিএনপি প্রথম দিকে এটা মেনে না নিলেও শেষ পর্যন্ত একটা এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সংবিধানে তা (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা) অন্তর্ভুক্ত করে তারা পদত্যাগ করেছে। এটা একটা রাজনৈতিক সমঝোতা ছিল। কিন্তু সেটাও বাতিল করা হয়েছে। এ ব্যাপারে দুই দলের দায় আছে। যদিও আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ অসাংবিধানিকভাবে এটা সংশোধন করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছে। এগুলো গভীরভাবে দেখা দরকার এবং সংবিধানে পরিবর্তন আনা দরকার।
তিনি বলেন, পুরো সংবিধান বাদ দিয়ে নতুন করে সংবিধান রচনা করা সহজ নয়, দুরূহ এবং সময়সাপেক্ষ বিষয়। তবে এ সংবিধানের কতগুলো বিষয়ে সুদূরপ্রসারী গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারি। যেমন- নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কেমন হবে। আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সক্ষমতার ভারসাম্য। ৭০ অনুচ্ছেদসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে। এসব বিষয় ভাবতে হবে। তিনি বলেন, সংবিধানে কতগুলো ভয়াবহ বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ৭(ক) অনুচ্ছেদ। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যা সংযুক্ত করা হয়েছে। এই বিধান যদি বাতিল না হয়, তবে প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে যারা আমরা সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলছি তাদের সবাইকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হবে। সবাইকে কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হবে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বৈষম্য এখনো চলমান। সংবিধান সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে নতুন করে লেখা বেশ কঠিন। নতুন বাংলাদেশে নতুন সংবিধানে মৃত্যুদণ্ডকে বাদ দেওয়া প্রয়োজন। মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে মৌলিক অধিকারের ওপরও জোর দেওয়া প্রয়োজন। সংবিধানের ব্যাখ্যা আসা প্রয়োজন প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকেই। সংবিধানের সংশোধনের জন্য প্রয়োজন ভিন্ন মত, ধর্মের সবার অংশগ্রহণ দরকার।