রংপুর শহরের অদূরে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে সাহেবগঞ্জ বাজার এলাকায় প্রস্তাবিত ইপিজেডটির অবস্থান। এই ইপিজেড থেকে সৈয়দপুর বিমানবন্দর ৭০ কিলোমিটার, হিলি স্থলবন্দর ৩২ কিলোমিটার এবং সম্প্রসারণাধীন বগুড়া বিমানবন্দরের অবস্থান ৩৪ কিলোমিটার দূরে। উত্তর জনপদের উত্তরের ৮ জেলার প্রবেশদ্বার খ্যাত গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ এবং গোবিন্দগঞ্জের সংসদীয় এই আসনটি। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বস্থানীয় নেতৃবৃন্দ সহ প্রতিটি সচেতন মহলের নিকট প্রস্তাবিত ইপিজেডটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন বলে ব্যাখ্যা করেন।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘রংপুর চিনিকলের মালিকানাধীন সাহেবগঞ্জ বাণিজ্যিক খামারের জমিতে ‘রংপুর ইপিজেড’স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হওয়ায় খুশী গোবিন্দগঞ্জের স্থানীয়রা। মঙ্গাপীড়িত উত্তর জনপদের লক্ষ লক্ষ প্রান্তিক মানুষের কাছে এ যেন এক নতুন স্বপ্নের ঠিকানা। সাইনবোর্ড টানানোর মাধ্যমে দেশের ১০ম ইপিজেড হিসেবে রংপুর ইপিজেড এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর পর থেকে স্থানীয়দের খুশীর পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। এই ইপিজেড বাস্তবায়ন হলে এলাকার সাঁওতাল সম্প্রদায়সহ জেলার প্রায় ২লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে স্বপ্ন দেখছেন এখানকার সকল পেশার মানুষ।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে গোবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর ভায়া-ঘোড়াঘাট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশেই বন্যামুক্ত উঁচু জমিতে এই ইপিজেড স্থাপন প্রস্তাবিত করা হয়েছে। এই ইপিজেড থেকে ৩২ কিলোমিটার দুরে হিলি স্থলবন্দর আর ৭০কিলোমিটার দুরে সৈয়দপুর এবং ৩৪ কিলোমিটার দুরে সম্প্রসারণাধীন বগুড়া বিমান বন্দরের অবস্থান। এছাড়াও প্রস্তাবিত ইপিজেড থেকে মহিমাগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের দুরত্ব ১৭ ও গাইবান্ধা রেলস্টেশনের দুরত্ব ৩২ কিলোমিটার এবং ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের দুরত্ব মাত্র ৬ কিলোমিটার। যে কারণে যোগাযোগ ও মালামাল সরবরাহ এবং পরিবহনের ক্ষেত্রে এই ইপিজেড অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় বেপজা এই স্থান নির্বাচনে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন।
শিল্পমন্ত্রণালয়ে প্রেরিত রংপুর চিনিকল ও উপজেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, রংপুর চিনিকলের আওতাধীন সাহেবগঞ্জ খামারটি ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় উপজেলার সাপমারা ইউনিয়নের ১৯/৫৪-৫৫ এল এ কেস নং মোতাবেক নরেঙ্গবাদ মৌজার ১১৯ জেএল নন্বরে সাঁওতালদের ২১৬ একর ৭৭ শতক এবং অন্যানদের ৫৬৬ একর ২ শতক, ২৮/৫৪-৫৫ এল এ কেস নং মোতাবেক চকরহিমাপুর মৌজার ১১৪ জেএল নম্বরে সাঁওতালদের ১শ’ ৩ শতক ও অন্যান্যদের ৪৯ একর ৮৫ শতক , ২৯/৫৪-৫৫ এলএ কেস নং মোতাবেক রামপুর মৌজার ১১২ জেএল কেস নম্বরে সাঁওতালদের ৫০ একর ১৬ শতক ও অন্যান্যদের ২শ ৬০ একর ১৭ শতক, ৩০/৫৪-৫ এল এ কেস নং মোতাবেক সাপমারা মৌজার ১১৩ জেএল নম্বরে সাঁওতালদের ৫০একর ৩ শতক ও অন্যান্যদের ২শ ১৩ একর ১ শতক, ৫২/৫৪-৫৫ এলএ কেস নং মোতাবেক মাদারপুর মৌজার ১২০ জেএল নম্বরে সাঁওতালদের ১শ ৫৮ একর ৪৪ শতক ও অন্যানদের ৩শ ৩৬ একর ১৬ শতক জমি এলএ কেসের মাধ্যমে অধিগ্রহণ ও ডিড অব এগ্রিমেন্ট দলিল মুলে সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার মোট জমির পরিমাণ ১ হাজার ৮শ’ ৪২ একর রাস্তাসহ। খামারটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বন্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রতি বছর মাড়াই মৌমুমে কাঁচামাল হিসেবে এখানকার উৎপাদিত আখ চিনিকলে সরবরাহ করা হতো। বর্তমানে চিনিকলটির উৎপাদন বন্ধ থাকায় সাহেবগঞ্জ বাণিজ্যিক খামার পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
সরকার রুগ্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান সচল করার অংশ হিসেবে বন্ধ হওয়া ইক্ষু খামারের ৪৫০ একর জমিতে ইপিজেড স্থাপন করে বিকল্প ব্যবস্থায় কর্মসংস্থানের উদ্যোগের নেয়। এর অংশ হিসেবে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর মাননীয় প্রধান মন্ত্রী সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বেপজা গভর্নর বোর্ডের ৩৪ তম সভায় গৃহীত অন্যান্য সিদ্ধান্তের মধ্যে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের ১হাজার ৮শ ৩২ একর জমিতে ‘রংপুর রপ্তানী প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা’ (আরইপিজেড) স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে মোতাবেক শিল্পমন্ত্রণালয় এ জমি বেপজার অনুকুলে হস্তান্তরের নির্দেশনা দেয়। ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নিমিত্তে তপশীলি জমির বাজার মূল্য ২০২০ সালের ২৫ জুলাই ০৫.৫৫.৩২০০.০১০.২১.০০৭.২০২০.১১৭ নং স্বারকে উক্ত জমির মৌজা ও জমির শ্রেণিভিত্তিতে জমির মূল্য নির্ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ইতিমধ্যে খামারটি রংপুর চিনিকলের নিয়ন্ত্রণাধীন হওয়ায় চিনিকলের নামানুসারে ইপিজেড এর নামকরণ করেছে রংপুর ইপিজেড (আরইপিজেড)। ইতোমধ্যে স্থাপনের প্রাথমিক কাজের অংশ হিসেবে শিল্পমন্ত্রণালয়ে ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পৃথক পৃথক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ২৫ মে আরইপিজেড এর নামে গোবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর ভায়া -ঘোড়াঘাট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে ৩টি সাইনবোর্ড লাগানোর কারণে এলাকায় বইয়ে চলে আনন্দের বন্যা। তারই ধারাবাহিকতায় হোক প্রতিবাদ, হোক আবদার, এই মুহুর্তে গোবিন্দগঞ্জে ইপিজেড দরকার, এই শ্লোগান কে সামনে রেখে গোবিন্দগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় ব্যাচ অফ ২০১৭ এর আয়োজনে প্রাণের গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর ইপিজেড দ্রুত বাস্তবায়নের দাবীতে গোবিন্দগঞ্জ শহরের চারমাথা মোড়ে গতকাল শনিবার ১৭ ই ফেব্রুয়ারী বিকাল ৪টায় ঘন্টাব্যাপী পথসভা ও মহাসড়কের দুইধারে পথচারী ও পরিবহনের যাত্রীদের মাঝে, বাজারের বিভিন্ন গলিপথে ঢুকে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মাঝে লিফলেট বিতরণ ও মানববন্ধন করেন।
আরইপিজেড সংলগ্ন কাইয়াগঞ্জ গ্রামের আমির হোসেন বলেন, কাজের জন্য আগে ছেলে-মেয়েদের ঢাকা পাঠাতাম। এখানে ইপিজেড নির্মাণ সম্পন্ন হলে তারা এখানেই তাদের কাজ পাবে।
কাটাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জোবায়ের হাসান শফিক মাহমুদ গোলাপ বলেন, সাহেবগঞ্জ বাণিজ্যিক খামারে আরইপিজেড বাস্তবায়ন হলে এই এলাকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে।
সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রভাষক শাকিল আকন্দ বুলবুল বলেন, সাহেবগঞ্জ বাণিজ্যিক খামারে আরইপিজেড বাস্তবায়ন হলে এই এলাকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। সাহেবগঞ্জ বাণিজ্যিক খামারে এই ইপিজেড স্থাপনে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে এবং সে মোতাবেক বেপজা তাদের যাবতীয় কার্যক্রম এগিয়ে নিয়েছে।
ইপিজেড দ্রুত বাস্তবায়নের দাবীর মানববন্ধনের প্রধান অতিথি পৌর মেয়র মুকিতুর রহমান রাফি বলেন, গোবিন্দগঞ্জে রংপুর ইপিজেড বাস্তবায়ন হলে প্রায় ২থেকে ৫ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ইপিজেড কেন্দ্রিক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দিনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এলাকার নিরাপত্তার জন্য শিল্প পুলিশ জোন ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপিত হবে। বানিজ্যিক ক্ষেত্রে হাট-বাজার, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, সিনেমা হল, ক্লিনিক, রেস্টুরেন্ট ও শপিংমল স্থাপন হবে। আবাসিক ক্ষেত্রে ইপিজেডের কর্মরত মানুষের জন্য বহুতল ভবন, মেস, বাসা-বাড়ী, রেস্ট-হাউজ ও আবাসিক হোটেল নির্মাণ হবে। যোগাযোগ ক্ষেত্রে নতুন রুটে বিভিন্ন যানবাহন চলাচল ও হেলিপ্যাড চালু হবে। গাইবান্ধা, বগুড়া, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও রংপুর জেলাসহ উত্তরাঞ্চলের বেকাত্বের হার কমে যাবে। দেশে আরও দক্ষ জনবল সৃষ্টি হবে। এই দক্ষ জনবল ভবিষ্যতে দেশবিদেশে কাজ করবে। রংপুর ইপিজেডে বিদেশী বিনিয়োগ হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। ইপিজেডের পণ্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা উপার্জিত হবে। এ এলাকার ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ঘটবে। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত গোবিন্দগঞ্জে রংপুর ইপিজেড দ্রুত বাস্তবায়নের দাবী জানান তিনি।
অন্যান্য বক্তারা অবিলম্বে রংপুর ইপিজেড এর অবকাঠামো নির্মাণ সহ যাবতীয় কার্যক্রম শুরু করার দাবী জানান। সেই সাথে মহান জাতীয় সংসদে ইপিজেড বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ শুরুর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আর্কর্ষণ করে বক্তব্য দেয়ায় সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
গাইবান্ধা-৪ আসনের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ এমপি মহোদ্বয় জানান, আরইপিজেড নির্মাণ ও উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করলে মঙ্গাপীড়িত এ জনপদ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সমগ্র গাইবান্ধা জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ২ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে এখানে। আমি গাইবান্ধা-৪ গোবিন্দগঞ্জ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ রংপুর ইপিজেড দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করে সংসদে বক্তব্য রেখেছি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ৭১ বিধিতে এই বক্তব্য প্রদান করার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত ছিলেন। পাঁচ মিনিটের বক্তব্যে রংপুর ইপিজেড দ্রুত বাস্তবায়ন এবং উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া, বাঙালি ও কাটাখালী নদীর দুই পাশে থাকা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানি বাঁধের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে প্রবেশ করে পৌরসভার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ডুবে যায়। বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করোতোয়া কাটাখালি ও বাঙালি নদীর দুই তীরে ক্ষতিগ্রস্থ বন্যা নিয়ন্ত্রিত বাঁধ দ্রুত সংস্কারে দাবি জানায়। এছাড়াও এলাকার আখ চাষীদের হতাশা থেকে বাঁচাতে বন্ধ হওয়া মহিমাগঞ্জস্থ, জেলার একমাত্র ভারী শিল্প রংপুর চিনিকল চালু করে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া আশ্বাস পূরণের দাবি জানায়।