অনিয়ম যেখানে নিয়মিত সীমাহীন দূর্নীতি (পর্ব ০২)

জাতীয়

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার প্রকল্পে অনিয়ম, কাজ না করেই অর্থ লোপাট!
২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি

ওয়াজেদ আলীঃ
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারসহ বেশ কয়েকটি কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ১৯টি প্রকল্পের প্রায় অর্ধ কোটি টাকা কাগজে-কলমে নামমাত্র কাজ দেখিয়ে প্রকল্পের টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ৩২ গাইবান্ধা ৪ গোবিন্দগঞ্জ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ জিন্দার আলী এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির বিরুদ্ধে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) অফিস সূত্র জানা গেছে, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার একটি পৌরসভা ও আটটি ইউনিয়নে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার বাবদ কাবিখা, কাবিটা কর্মসূচির আওতায় (৪র্থ পর্যায়) নির্বাচনী এলাকা ভিত্তিক সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্যের অনুকূলে ১৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ৫০ (পঞ্চাশ) লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সরজমিনে বেশ কয়েকটি প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে প্রাপ্ত বরাদ্দের প্রকল্পের স্থানে যে কাজ হয়েছে তার কোনো চিহ্নহ্নই নেই, নেই কোথাও গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কাজের সাইন বোর্ড। দু-একটি প্রকল্পের কিছু অংশ কাজ হলেও বেশির ভাগ প্রকল্পই নামমাত্র কাগজে কলমে, কোন কাজ না-করেই সাবেক সংসদ সদস্য, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি পরষ্পর যোগসাজসে টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে এই মর্মে অভিযোগ উঠেছে।
প্রকল্পের কাজের তালিকা অনুযায়ী খোজ নিয়ে জানা যায় উপজেলার পৌরসভার চাঁদপুর খলসি মসজিদ হতে ঈদগাহ মাঠ পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল দুই লাখ টাকা, যা কোনো কাজ না করেই টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। ওই এলাকার জনগন জানান, বিগত কয়েক বছরেই রাস্তাটি সংস্কার হয়নি। তাই যাতায়াতকারীরা বড় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। পৌরসভার ঘোষপাড়া ডা.সাঈদ এর বাড়ী হতে দূর্গাপুর রাস্তার মোড় পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার প্রকল্পে বরাদ্দ দুই লক্ষ টাকা, ওই এলাকাবাসী জানান রাস্তায় যাতায়াতের অসুবিধার কারণে বাড়ীওয়ালারা তাদের নিজেদের টাকা দিয়ে তাদের বাড়ীর সামনে মাটি দিয়ে ভরাট করছে, পৌরসভার বোয়ালিয়া নতুন গরু হাটির মাঠ ভরাট করণ প্রকল্পে বরাদ্দ চার লক্ষ টাকা এলাকাবাসী জানান এইটা স্কুলের জমি কাটাখালী ব্রীজের নীচে হইতে পৌরসভা ২নং ওয়ার্ড কমিশনার জাফু ও মামুন মেম্বর নিজেদের অবৈধ বালুর পয়েন্ট থেকে বিটবালু কেটে এনে যেনতেনভাবে ভরাট করেছে, পৌরসভার গোবিন্দগঞ্জ থানার উত্তর পার্শ্বে প্রাচীর সংলগ্ন মাঠে মাটি ভারাট করণ এক লক্ষ টাকা, টপসি আইসক্রিম মোড় হতে পৌরসভার মোড় গেট পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার প্রকল্পে বরাদ্দ দুই লক্ষ টাকা যা একটি টাকারও কোনো কাজ না করেই টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।

উপজেলার নাকাই ইউনিয়নে ‘পোগইল হ্যাগারার ভিটা হতে শিমুলতলী বাজার পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল এক লক্ষ টাকা, যা কোনো কাজ না করেই তুলে নেয়া হয়েছে। ওই এলাকার আবু মুছা জানান, রাস্তাটি সংস্কার হয়নি। তাই যাতায়াতকারীরা বড় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। প্রকল্প কমিটির সভাপতি থাকার কথা নাকাই ইউনিয়নের স্থানীয় ইউপি সদস্য পারভেজ আহম্মেদ। তবে নাকাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় ইউপি সদস্য পারভেজ আহম্মেদ ওই প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানান।
সেই সাথে অন্যান্য প্রকল্পর এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, গুমানীগঞ্জ ইউনিয়নের গোয়ালপাড়া মজিদের বাড়ী হতে সাতালপাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার চার লক্ষ টাকা, অনন্তপুর ক্লিনিক হতে মসজিদ পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার চার লক্ষ টাকা, কৃষ্ণপুর ছয়ঘরিয়া পাকা হতে হাবির নার্সারি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার চার লক্ষ টাকা, কোচমর্দন বাড়ইপাড়া জলিলের কবরস্থান হতে নামাপাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার পাঁচ লক্ষ টাকা। তবে গুমানীগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় ইউপি সদস্য ওই প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানান।

কামারদহ ইউনিয়নের চাঁদপাড়া রসুলের বাড়ী হতে উত্তরপাড়া জহুরুলের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার চার লক্ষ টাকা, শেরপুর রইচ মহুরীর বাড়ী হতে শরীফের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার চার লক্ষ টাকা, চাঁদপাড়া নান্নুর বাড়ী হতে খোরশেদের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার চার লক্ষ টাকার বরাদ্ধ দেওয়া হলেও সেখানে কোন কাজই হয় নাই, কোচাশহর ইউনিয়নের কোচাশহর রফিকুলের বাড়ীর নিকট ব্রীজ হতে আনোয়ার সর্দারের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার এক লক্ষ টাকা, সাপমারা ইউনিয়নের চকরহিমাপুর সাধনের বাড়ী হতে বাঁধ পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার দুই লক্ষ টাকা, ফুলবাড়ী ইউনিয়নের বড় সাতাল-বাতাইল মোজামের বাড়ী হতে ময়েন উদ্দিনের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার দুই লক্ষ টাকা, শালমারা ইউনিয়নের হাবিবের বাইগুনী সুজনের বাড়ী হতে ফরহাদের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার এক লক্ষ টাকা, দরবস্ত ইউনিয়নের হোসেনপুর আইনুলের বাড়ী হতে ফকিরপাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার এক লক্ষ টাকা, মিরুপাড়া বাকির বাড়ী হতে আনিছুরের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার দুই লক্ষ টাকা বরাদ্ধ হলেও কোথাও কানাকড়ি টাকার কাজও হয় নাই যা কোনো কাজ না করেই কাগজে কলমে শতভাগ কাজ দেখিয়ে ভুয়া মাষ্টার রোলের মাধ্যমে এসব প্রকল্পের অনুকুলে বরাদ্ধ করা অর্থ উত্তোলন করে নেওয়া হয়েছে।

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সচেতন মহল জানান, প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি নতুন নয়। কাগজে-কলমে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়ে বেশির ভাগ প্রকল্পের টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। কোথাও কাজ হয়েছে নামমাত্র। জনপ্রতিনিধি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির যোগসাজশে কাজ না করেই এসব বরাদ্দ লোপাট হয়। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জিন্দার আলীর বিরুদ্ধে এর আগেও এ ধরনের অনেক অভিযোগ উঠেছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় বিভিন্ন সময়ে নানারকম অনিয়ম সম্পর্কে সোশাল মিডিয়া, পত্র-পত্রিকায় যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা এক কথায় ভয়াবহ। এসব অনিয়মের ঘটনা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মনিটর করা উচিত। অতীতে দেখা গেছে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ সেক্টরে অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার পরও দুর্নীতিবাজরা শাস্তির সম্মুখীন হননি; বরং নানাভাবে ম্যানেজকরে তা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। এরকম চলতে থাকলে এ প্রতিষ্ঠান থেকে অনিয়ম দূর করা সম্ভব নয় বলে মনে করি আমরা। প্রকল্পের অপচয়, অনিয়ম ও দুর্নীতির বদনাম ঘোচাতে এবং মানসম্মত কাজ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। সচেতন মহল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর দৃষ্টি আকর্ষন করেন দুর্নীতির সাথে জড়িত দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির সম্মুখীন করার জন্য।

গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান রিপন জানান এই প্রকল্পের বরাদ্ধ হয়েছে কি না তাহা আমি জানিনা তবে আমি অফিস থেকে জেনে আপনাকে জানাবো। গুমানীগঞ্জ ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড সদস্য মোঃ মাহাতাব উদ্দীন বলেন আমার জাানা মতে ৪র্থ পর্যায় প্রকল্পর কোন কাজই হয় নাই।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জিন্দার আলীকে অফিসে গিয়ে না পাওয়া গেলে তাহার নিকট মোবাইলে এসব প্রকল্পের সভাপতি, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ও কাজের ঠিকাদারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান অফিসের কাগজপএ এলোমেলো হয়ে আছে, হারিয়ে গেছে কিছু কিছু কাগজপত্র এমনকথাবলে তিনি অফিসে ডেকে বসেন আসছি বলে অফিসে সাংবাদিকতে বসিয়ে রেখে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জিন্দার আলী বাসায় চলে যান, তারপর একাধিকবার ফোন দেওয়া হইলেও আর ফোন রিসিভ করেন নাই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাসেল মিয়া বলেন, এসব প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে এবিষয়ে আমি কিছুই জানিনা তারপরও আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখব। আপনি প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) অফিস থেকে জেনে নিন।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই লাপাত্তা, আত্মগোপনে রয়েছেন ৩২ গাইবান্ধা ৪ গোবিন্দগঞ্জ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ। আত্মগোপনে থাকায় তাহার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয় নাই।

(পরবর্তী পর্ব, প্রকল্পের ৩য় পর্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *