ভারতে গিয়ে নিখোঁজ ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার কলকাতায় খুন হয়েছেন। মরদেহ উদ্ধার না হলেও সুনির্দিষ্ট কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে, কলকাতার নিউ টাউনের অভিজাত আবাসিক এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে। হত্যার পর মরদেহ টুকরা টুকরা করে অজ্ঞাতনামা স্থানে গুম করে ফেলেছে খুনিরা। এ ঘটনায় পুলিশ ঢাকার মোহাম্মদপুর ও সাভার থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁরা ৫ কোটি টাকার চুক্তিতে কলকাতায় ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করেছেন। পুরো কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেন আমানউল্লাহ নামের একজন। তাঁকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় দায়ের করা মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এমপি আনার হত্যায় ঢাকা ও কলকাতায় দুটি পৃথক মামলা হয়েছে। কলকাতার মামলাটি পশ্চিমবঙ্গের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে।
দুই দেশের পুলিশের সন্দেহ, হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে সোনা কারবারের টাকা লেনদেন নিয়ে বিরোধ। ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার আক্তারুজ্জামান শাহীনের পরিকল্পনায় এই হত্যাকাণ্ড হয়। খুন করার আগে বিলাসবহুল একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে দেশ থেকে ছয়জনের একটি কিলিং স্কোয়াড নিয়ে যান তিনি। পরে ব্যবসায়িক আলোচনা করতে ফ্ল্যাটে ডেকে এমপি আনোয়ারুল আজীমকে হত্যা করা হয়। টুকরা টুকরা করে কাটা হয় লাশ। এরপর উবার ভাড়া করে ট্রলিতে ভরে সেই লাশ গুম করেন কিলিং মিশনের সদস্যরা।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের এমপি আনোয়ারুল আজীম কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ১১ মে তিনি দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে চিকিৎসার কথা বলে ভারতে যান। সেখানে গিয়ে বরাহনগরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু ১৬ মে থেকে তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে না পারায় ১৮ মে বরাহনগর থানায় একটি নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন গোপাল বিশ্বাস।
গতকাল বুধবার সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে আনারের খুন হওয়ার খবর আসে। পরে দুপুরে ঢাকার ধানমন্ডিতে নিজের বাসায় পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যতটুকু তথ্য তাঁরা পেয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের লোকজনই পরিকল্পিতভাবে আনোয়ারুল আজীমকে খুন করেছেন।
খুন করতে ফ্ল্যাট ভাড়া
ঢাকার গোয়েন্দা ও কলকাতা পুলিশ সূত্র বলছে, এককভাবে এই খুনের পরিকল্পনা করেন এমপি আনোয়ারুল আজীমের বাল্যবন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীন। তিনি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভা মেয়র মো. সহিদুজ্জামানের ছোট ভাই। শাহীন আমেরিকারও নাগরিক। খুনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শাহীন গত ৩০ এপ্রিল কলকাতায় যান। সেখানে নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনস এলাকার ইউভি ৫৬ নম্বর ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। তাঁর সঙ্গে অবৈধভাবে কলকাতায় নিয়ে যান আমানউল্লাহকে। আমানউল্লাহর নেতৃত্বে ওই ফ্ল্যাটে আরও ওঠেন পাঁচজন। সেই ফ্ল্যাটে ১০ দিন বসে এমপিকে খুনের পরিকল্পনা করেন তাঁরা। সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর গোপনে ১০ মে দেশে ফেরেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। শাহীনের কথায় ১১ মে দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে চিকিৎসার কথা বলে ভারতে যান আনোয়ারুল আজীম। ১৩ মে সকালে সঞ্জীবা গার্ডেনস এলাকার ইউভি ৫৬ ফ্ল্যাটে যান তিনি। সেখানে পুরোনো কিছু ব্যবসায়িক হিসাব মেটানোর কথা ছিল। কিন্তু এমপিকে খুন করতে আগে থেকেই ওই ফ্ল্যাটে অবস্থান করছিলেন দুই খুনের মামলায় ২০ বছর জেল খাটা আমানউল্লাহ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সহযোগী সিয়াম, জিহাদ, ফয়সাল শাহাজিদ, মোস্তাফিজুর রহমান ফকির। তাঁরা এমপি আনারকে খুনের পর প্রায় দুই ঘণ্টা সময় নিয়ে দা দিয়ে মরদেহ কয়েক টুকরা করেন। পরে লাশের টুকরোগুলো ট্রলিতে ভরে ফেলেন। রক্তের দাগ মুছে ফেলতে ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয় ফ্ল্যাটটি।
যেভাবে রহস্য উদ্ঘাটন করল পুলিশ
এমপি আনারের বন্ধু গোপাল বিশ্বাস জিডিতে উল্লেখ করেন, ১৩ মে দুপুরে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি আনোয়ারুল আজীম। পরে দেশে তাঁর ছোট মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর বাবার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি জানান। পরের কয়েক দিনে দুই দেশের পুলিশের মধ্যে যোগাযোগের পর বুধবার সকালে কলকাতার সংবাদমাধ্যমে এমপি আনারের খুন হওয়ার খবর আসে।
দুই দেশের পুলিশ সূত্র বলছে, খুনের পর ১৩ মে বিকেলে একটি উবারে চালিত গাড়িতে করে লাশের টুকরো ভর্তি ট্রলি নিয়ে বের হয়ে যান কিলিং মিশনের দুই সদস্য। পুলিশ সদস্যরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেই উবারচালককে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ করেন। যে উবার অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁকে সেদিন ডাকা হয়েছিল, তা খুঁজে পায় পুলিশ। সেখানে ভেসে আসে এক বাংলাদেশির ফোন নম্বর। সেই নম্বরের সূত্র ধরে গ্রেপ্তার হন কিলিং মিশনের হোতা আমানউল্লাহ। গ্রেপ্তার হওয়ার পরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অনেক বিষয়ে তথ্য দেন।
এদিকে ঘটনাস্থল নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনস থেকে বেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের আইজি (সিআইডি) অখিলেশ চতুর্বেদী জানান, এমপি নিখোঁজের ঘটনায় ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট থেকে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়। এরপরে পুলিশ এই ফ্ল্যাট শনাক্ত করে। কারণ, এখানেই তাঁকে শেষবার দেখা গিয়েছিল। পরবর্তী বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে আরও তদন্ত চলছে। সিআইডি এই তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছে।
পরিবারের সদস্যরা যা বলছেন
গতকাল সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ের কিছুক্ষণ পর ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। আমি বাবার হত্যার বিচার চাই। আমি দেখতে চাই, কারা আমাকে এতিম করল। কারা হত্যাকারী। বাবার হত্যাকারীদের ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যু দেখে যেতে চাই। আমি এর শেষ দেখতে চাই, তারা কেন বাবাকে হত্যা করেছে?’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে ডরিন বলেন, ‘আমার একটাই অনুরোধ, আমার বাবার হত্যার সুষ্ঠু বিচার করুন। একসময় বাবা ১৪ বছর মিথ্যা মামলায় পালিয়ে পালিয়ে থেকেছেন। তখনো আমি আমার বাবাকে কাছে পাইনি। এখন আবার বাবাকে হারিয়ে ফেললাম।’
আক্তারুজ্জামান শাহীন এখন দুবাইয়ে
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র বলছে, ১৩ মে এমপি খুন ও লাশ গুম নিশ্চিত করার পর ১৫ মে আকাশপথে কলকাতায় যান আক্তারুজ্জামান শাহীন। সেখানে গিয়ে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া পাঁচ সদস্যকে বৈধ ও অবৈধ পথে দেশে ফেরত পাঠান তিনি। এরপর ১৮ মে ভারত থেকে নেপালে চলে যান তিনি। তবে এ ঘটনার পুরো সময় সেই ফ্ল্যাটে একজন মেয়ে ছিলেন। আক্তারুজ্জামান শাহীনের বান্ধবী পরিচয় দেওয়া মেয়েটির নাম শিলাস্ত্রী। তাঁর বাড়ি টাঙ্গাইলে। গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তবে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে শিলাস্ত্রী আগে থেকে কিছু জানতেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কিলিং মিশনের প্রধান ব্যক্তি আমানউল্লাহ দেশে গ্রেপ্তারের পর নেপাল থেকে সটকে পড়েন শাহীন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার তিনি দুবাইয়ে চলে যান।
আক্তারুজ্জামান শাহীনের বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁর বড় ভাই সহিদুজ্জামান বলেন, নিহত এমপি আনোয়ারুল আজীমের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। তাঁরা একসঙ্গে স্বর্ণের ব্যবসা করতেন কি না জানা নেই। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ কম হয়। হত্যার সঙ্গে জড়িত কি না, এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে তিনি দাবি করেন।
২০ বছর জেল খাটেন আমানউল্লাহ
গোয়েন্দা পুলিশের তথ্যমতে, এমপি আনারকে নেতৃত্ব দেওয়া আমানউল্লাহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন। পরে রাজশাহীতেই একটি হত্যা মামলায় ১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন। পরে ২০০০ সালে যশোরের অভয়নগর এলাকায় আরেকটি হত্যা মামলায় ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন। এমপি আনারকে হত্যার জন্য ৩০ এপ্রিল বেনাপোল দিয়ে অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় যান তিনি।