বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান এর নিকট মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সংস্কার প্রস্তাব

প্রযুক্তি
হাফিজুল করিম রুবেল  বিশেষ প্রতিনিধি : 
আজ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব:) এমদাদুল হক বারিক সাহেবের নিকট সংস্কার প্রস্তাব তুলে দেয় বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন এর সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ এর নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলে উপস্থিত ছিলেন, নিলয় কমিটির সদস্য এডভোকেট মনিরুজ্জামান শাশ্বত মনির, প্রকৌশলী আবু সালেহ ও তথ্য দপ্তর সম্পাদক শেখ ফরিদ। কমিশনের চেয়ারম্যান এ সময় বলেন, কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে, এর জন্য গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন কে সহযোগিতা করতে হবে। সেই সাথে কোয়ালিটির সার্ভিসের সাথে যুক্ত বিষয় গুলি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। কেন মানহীন সেবা দেওয়া হচ্ছে সেটি খুঁজে বের করে কমিশনকে জানাতে হবে। পাশাপাশি গ্রাহকদের কে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং গ্রাহকের সঠিক তথ্য কমিশনকে জানিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। সংগঠনের পক্ষ থেকে মহিউদ্দিন আহমেদ বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে বলেন, আমরা দীর্ঘ ১০ বছর যাবত কমিশনকে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে সহযোগিতা করে আসছি। আমরা চাই কমিশন আইন সংস্কার করে কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে সার্বিক সহযোগিতা করতে। এবং গ্রাহকদের অধিকার রক্ষায় কমিশন কে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শতভাগ মানুষের চাহিদা মেয়াদহ ইন্টারনেট ডাটা এ ব্যাপারে কমিশনকে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
গত  ৮ আগস্ট ২০২৪ অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্ব নেবার সাথে সাথে ছাত্র জনতা রাজনৈতিক সংগঠন এবং সামাজিক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে সারাদেশে সকল প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের দাবি উঠে। ইতোমধ্যে  মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে।
চেয়ারম্যানের কাছে নিম্নলিখিত প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়।
১. টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন: বাংলাদেশ টেলিযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ (সংশোধনী ২০১০) সময় উপযোগী করে তুলতে ও বেশ কিছু অসামাজস্য থাকায় এই আইন সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা একান্ত আবশ্যক। এই আইনটি করার উদ্দেশ্য ছিল টেলিযোগাযোগ সেবার মান উন্নয়ন ও দক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রণের নিমিত্ত একটি স্বাধীন সার্বভৌম কমিশন প্রতিষ্ঠা করা। পাশাপাশি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা ও কার্যাবলী কমিশনের কাছে হস্তান্তর করা এবং প্রয়োজনীয় বিধান যুক্ত করা। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি কমিশন সম্পূর্ণভাবে মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীল। কমিশন মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করে কিন্তু মন্ত্রণালয় কমিশনে আবেদন করে না। এমনকি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ছাড়া কোন লাইসেন্স ও ট্যারিফ প্রদান করা হয় না। আমরা মনে করি কমিশনের কাছে সকল ক্ষমতা থাকবে। কমিশন হবে সার্বজনীন এবং জবাবদিহিতামূলক ন্যায়পরায়ণতা ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। সরকার কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে তা কমিশনের কাছে আবেদনের মাধ্যমে জানাবে এবং জনগণের মতামত নিয়ে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।
২. কমিশন গঠনের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা: কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে অর্থাৎ কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অযোগ্য ধারা ১০ এ একই সাথে কমিশন গঠন ৭ ধারায় বলা আছে বাংলাদেশের নাগরিক নয় এমন ব্যক্তিকে কোনোভাবেই কমিশনের নিয়োগ করা যাইবে না। অথচ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান শাজাহান মাহমুদ চৌধুরী একজন মার্কিন নাগরিক হয়েও কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন। একই সাথে কমিশন গঠন ৭ ধারার (৩)এ বলা হয়েছে কমিশনের পদ শূন্যতা বা কমিশন গঠনে ত্রুটি থাকার কারণে কমিশনের কোন কার্য বা কার্যধারা অবৈধ প্রতিপন্ন হইবে না এবং তদ সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন করা যাইবে না। অর্থাৎ আইনের এই ধারা দুটি সম্পূর্ণভাবেই সাংঘর্ষিক এবং গণতন্ত্রের পরিপন্থী। তাই ধারা দুটি পরিবর্তন অর্থাৎ বাতিল করা অতি আবশ্যক বলে আমরা মনে করি।
৩. টেলিযোগাযোগ ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিগত সকল নিয়ন্ত্রণ বিটিআরসি কাছে থাকা অতি আবশ্যক: যেমন, ইন্টারনেট এর সকল মাধ্যম, অ্যাপ, ক্লাউড কম্পিউটিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ওটিটি প্লাটফর্ম, ইন্টারনেট ভিত্তিক লিনিয়ার টিভি, ডোমেইন, সহ-সকাল মাধ্যম বিটিআরসির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে এর একমাত্র নিয়ন্ত্রক কমিশন হবে বিটিআরসি। একই সাথে এনটিএমসিকে টেলিযোগাযোগ আইন অনুসরণ করে এবং বিটিআরসি’র পূর্বানুমোদন নিয়ে টেলিযোগাযোগ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম/মনিটরিং পরিচালনা করতে হবে। একই সাথে এনটিএমসিকে টেলিযোগাযোগ আইন অনুসরণ করে এবং বিটিআরসি’র পূর্বানুমোদন নিয়ে টেলিযোগাযোগ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম/মনিটরিং পরিচালনা করতে হবে।
৪.  ইন্টারনেট বন্ধ ও সচল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা: ইন্টারনেট কখন বন্ধ থাকবে কখন সচল থাকবে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে বিটিআরসির কাছে। ভবিষ্যতে কখনোই কোন পরিস্থিতিতেই যাতে ইন্টারনেট বন্ধ না থাকে এ ব্যাপারে বিটিআরসি কে স্পষ্টভাবে আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে। ইন্টারনেটকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে কমিশন হইতে স্বীকৃতি প্রদান করতে হইবে।
৫. ইন্টারনেট ও ভয়েজ কলের ট্যারিফ নির্ধারণ: মোবাইল অপারেটরগণ মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের প্রস্তাব কমিশনে উপস্থাপন করবে। কমিশন তার ভিত্তিতে একটি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি গঠন করে পর্যালোচনা করবে। পরবর্তীতে গ্রাহক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সকল স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে কমিশন এই মূল্য সম্পর্কে একটি গণশুনানি আয়োজন করবে। পরবর্তীতে সকলের মতামত সাপেক্ষে একটি যুক্তিক মূল্য নির্ধারণ করবে কমিশন।
৬. সরকার পতনের পর আমরা লক্ষ্য করেছি ইন্টারনেট ডাটা ও ভয়েস কলের মূল্য অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু কি কারণে কার অনুমতি সাপেক্ষে এই মূল্য বৃদ্ধি করা হলো তার একটি যুক্তি যুক্ত তদন্ত ও ব্যাখ্যা আমরা চাই।
৭. কমিশনে নিয়োগ পদ্ধতি: দলীয় বিবেচনা বা ব্যক্তির সুপারিশে এমনকি দুর্নীতির মাধ্যমে কোনভাবেই নিয়োগ প্রদান করা যাইবে না এমনকি পদোন্নতিও দেওয়া যাইবে না। বিগত কমিশনে দলীয় বিবেচনায় ও অনৈতিক অর্থের বিনিময়ে যে সকল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এ নিয়ে ইতিমধ্যে দেশের বেশ কিছু গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে সে বিষয়ে নতুন করে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে কমিশনকে।
৮. সেবার মূল্য কমানো প্রসঙ্গে: মধ্যস্বত্তভূমি আইসিএক্স, আইজিডব্লিউ, ভ্যালু এডেড সার্ভিস, তুলে দিলে ১০ থেকে ১২ শতাংশ মূল্য কমানো সম্ভব। সেই সাথে আইআইজি ও সাবমেরিন ক্যাবল সক্ষমতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে লাইসেন্স উন্মুক্ত করে দিলে আরো ১৫% মূল্য কমানো সম্ভব। একইভাবে পদ্মা সেতুর সার চার্জ এক শতাংশ তুলে দিলে আরো ১ শতাংশ মূল্য কমানো সম্ভব। একইভাবে অতিরিক্ত সিম ও কর সেবায় মূসক ও ভ্যাট কমানো গেলে এই মুহূর্তে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ মূল্য কমানো সম্ভব। এ ব্যাপারে কমিশন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবে আমরা প্রত্যাশা করি।
৯. টাওয়ারকো: ২০১৮ সালে দেশের চারটি টাওয়ারকো প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদান করা হলেও কেবলমাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান সক্ষমতা দেখিয়েছে। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে ফ্রন্টটিয়ার ইতিমধ্যে অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাই অযোগ্য প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে কমিশনকে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে একই সাথে এক হাতের লাইসেন্স অবমুক্ত করতে হবে প্রয়োজন হলে যোগ্য, সক্ষম প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।
১০. টাওয়ার কোয়ালিটি: টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে টাওয়ার গুলির গণগত মান কি হবে এবং পর্যবেক্ষণ কিভাবে করা হবে তার সুনির্দিষ্ট কোন ব্যাখ্যা না থাকায় দেশে মানহীন যন্ত্রপাতি, ব্যাটারি ও মাইক্রোওয়েভ দিয়ে টাওয়ার নির্মাণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কমিশনকে টাওয়ার কোয়ালিটি গাইডলাইন জারি করতে হবে।
১১. ওভারেট ফাইবার ক্যাবল: দেশের ঘঞঞঘ এর প্রায় ৬৫% কেবল এখনো ওভারহেড রয়েছে ফলে ঝড় বৃষ্টিতেই এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। একইভাবে শতভাগ ব্রডব্যান্ড ওভারঅ্যাড কেবল দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে যা সম্পূর্ণভাবে নিরবিচ্ছিন্ন সেবার সাথে সাংঘর্ষিক।
১২. গ্রাহক অভিযোগ নিষ্পত্তি: গ্রাহক অভিযোগ নিষ্কতির ক্ষেত্রে গ্রাহক দ্রুত সমাধান পাচ্ছে না। অথচ ৫৯ ধারায় বলা আছে যে, অভিযোগ দায়েরের সাত দিনের মধ্যে গ্রাহকের অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে হবে। এমনকি উপধারা (৬) এর অধীন প্রদত্ত নির্দেশ পালন করা না হলে কমিশন দ্বারা ৬৩ এর অধীনে বাধ্যতামূলক বাস্তবায়ন আদেশ জারি করিতে পারিবে। এখানে এটি হাস্যকর আইন রয়েছে যেমন ৪১ (ক) উক্ত লঙ্ঘন কারীর উপর অনধিক ৩০০ কোটি টাকা প্রশাসনিক জরিমানা এবং উক্ত আদেশের পর যতদিন লঙ্ঘন চলিতে থাকে উহার প্রতিদিনের জন্য অনধিক অতিরিক্ত এক কোটি টাকা প্রশাসনিক জরিমানা আরোপ করিতে পারে কমিশন। কিন্তু এই ধরনের জরিমানা কমিশন গঠনের পর থেকে কখনোই করা হয়নি তাই আমরা একে হাস্যকর আইনের ধারা বলছি। এই ধারা সমূহ পরিবর্তন করে জরিমানার পরিমাণ ও শাস্তি কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নামে এনে জনিমারা ২৫ শতাংশ অর্থ গ্রাহককে প্রদানের জন্য আমরা সুপারিশ করছি।
১৩. গণশুনানি: বছরে একবার নয় গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতি সপ্তাহে একদিন গন শুনানি অনুষ্ঠিত করতে হবে। এবং ট্যারিফ ও স্টেক হোল্ডারদের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে গণশুনানি প্রয়োজন অনুসারে অনুষ্ঠিত হবে।
১৪. সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল: সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের পূর্ণাঙ্গ তথ্য ৬ মাস অন্তর অন্তর প্রকাশ করতে হবে। এমনকি গ্রাহক স্বার্থে জনসচেতনতা সৃষ্টি বা নেটওয়ার্ক নির্মাণ এমনকি বিভিন্ন দুর্যোগের সময় ব্যয় করতে হবে।
১৫. দুর্নীতিমুক্ত কমিশন: কমিশনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে কমিশনকে স্বজনপ্রীতি ও আত্মীয়করণ এবং দলীয় মুক্ত করতে হবে। কমিশনের পিয়ন থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান পর্যন্ত প্রত্যেকের সম্পদের হিসাব সংরক্ষণ করতে হবে এবং প্রতি বছর সম্পদের হিসাব পর্যালোচনা করতে হবে।
১৬. গবেষণা: টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি সেবা ও ইন্টারনেটে গবেষণা খাতে মনোযোগী হতে হবে।
১৭. গুণগত মান সম্পন্ন সেবা: কমিশনকে গুণগত মান সম্পন্ন সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এক দেশ এক রেট গাইডলাইন বাস্তবায়নে মনোযোগী হতে হবে। অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় স্বাস্থিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সময় স্বল্পতার কারণে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার আমরা তুলে ধরতে পারছিনা। বিধায় এ বিষয়ে অধিকতর আলোচনার জন্য সকল প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা আশা করি আপনার নেতৃত্বে কমিশন কমিশনের মত পরিচালিত হবে সেই সাথে একটি স্বচ্ছ দুর্নীতিমুক্ত জবাবদিহিমূলক কমিশন যা হবে জনবান্ধব এবং গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *