মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটি বলছে, বিদেশে টাকা পাচার ছাড়াও ঢাকার কেরানীগঞ্জে তার মালিকানাধীন আবাসন প্রকল্প ‘প্রিয় প্রাঙ্গণ’ টিকিয়ে রাখতে সরকারি আবাসন ‘ঝিলমিল’ প্রকল্পের কার্যক্রম বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখেন। দুদক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিদ্যুৎ খাতের হরিলুটের উৎস ছিল কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট বা ভাড়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিনা টেন্ডারে প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি পাওয়ার প্লান্টের অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব উচ্চ মূল্যের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে চুক্তি অনুযায়ী বছরের পর বছর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে হাজার কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৬টি অর্থবছরে পরিশোধ করা হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর সিংহভাগই গেছে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ও জ্বালানি উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পকেটে। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি কোম্পানি খুলে ওই কোম্পানির মাধ্যমে নসরুল হামিদ বিপু হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগও পাওয়া গেছে। ওই কোম্পানি প্রতিষ্ঠাকালে বিপু তার নিজের যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত বাসভবনের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। পাঁচ বেডরুমের ওই বাসার বাজারমূল্য ৩৬ লাখ ১৭ হাজার ৪১৫ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এর মূল্য ৪২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। সেখানে শরীফ হায়দার নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে স্ত্রী সীমা হামিদকে নিয়ে ‘পাথ ফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি ট্রেড করপোরেশনের লাইসেন্স নেন। এই করপোরেশনের আওতায় মোবিল গ্যাস স্টেশনসহ দেড় ডজনের মতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ফ্লোরিডায় অবস্থিত ওই গ্যাস স্টেশনটি কেনা হয় কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে। আর শরীফ হায়দারের মাধ্যমেই হাজার কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন বিপু।
সূত্র জানায়, কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে দেশের বৃহত্তম এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজে জাল-জালিয়াতি ও দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কোম্পানির যৌথ ব্যবসায়িক জোট বা কনসোর্টিয়াম কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সঙ্গে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ভিত্তিতে ৩০৫ মিলিয়ন ডলার বা আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টার্মিনালটি নির্মাণে অংশ নেয়। মাত্র ১০০ ডলার পরিশোধিত মূলধনের একটি কোম্পানি পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল কীভাবে ৩০৫ মিলিয়ন ডলারের কাজ পায় তা নিয়ে তখনই প্রশ্ন ওঠে। দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট জানতে পারে, পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি হিসেবে সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশে নিবন্ধিত। এই কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নসরুল হামিদ বিপুর আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের হাতে। পাওয়ারকোর প্রধান শেয়ারধারী হলেন কামরুজ্জামান চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। তিনি নসরুল হামিদ বিপুর আপন মামা। পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনালের একজন বিকল্প পরিচালক মুরাদ হাসান। মুরাদ হাসানই আবার ‘ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট’ নামে হামিদ গ্রুপের একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও ছিলেন। এর আগে ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় নসরুল হামিদ নির্বাচনি হলফনামায় জানিয়েছিলেন- তিনি নিজেই ডেলকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বর্তমানে ডেলকোর মালিকানা তার ছেলে জারিফ হামিদ ও ছোটভাই এন্থেখাবুল হামিদের হাতে। জানা গেছে, পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল বারিধারার ৩২, প্রগতি সরণির ঠিকানাতে প্রথম নিবন্ধিত হয়েছিল। এই ঠিকানায় কেইমরিচ, সুনন ও ইউরো নামে তিনটি অফিস ফার্নিচার ব্র্যান্ডের শো-রুম আছে। বাংলাদেশে এই বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর পরিবেশক হলো ডেলকো। ডেলকোর ওয়েবসাইটেও তাদের শো-রুমের ঠিকানা : ৩২, প্রগতি সরণি, বারিধারা। আবার সুনন বাংলাদেশ বা sunon-bd.com ডোমেইনটির রেজিস্ট্রেশন রেকর্ড অনুযায়ী, এই ঠিকানাতেই এন্থেখাবুল হামিদের নামে নিবন্ধিত হয়েছে ডোমেইনটি।
অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট দুদক কর্মকর্তারা জানান, নসরুল হামিদ বিপুর দুর্নীতির নানা তথ্য হাতে এসেছে। এসব বিষয় তারা অনুসন্ধান করছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা, প্রিয় প্রাঙ্গণ আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে সরকারি ঝিলমিল প্রকল্পের কাজ কৌশলে বাধাগ্রস্ত করা এবং বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে।