২৫ ক্যাডারের বঞ্চিত উপসচিবরা পদোন্নতি চান

জাতীয়

দীর্ঘ সময় ধরে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে সচিবালয়। পদোন্নতিবঞ্চিত প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত বিশেষজ্ঞ ২৫ ক্যাডারের ১৩ থেকে ২২তম ব্যাচের উপসচিবরা সরকার পরিবর্তনের পর তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নেমেছে। ক্যাডার নির্বিশেষে বৈষম্যহীন মেধাভিত্তিক জনপ্রশাসন গড়ার লক্ষ্যে প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত বিশেষজ্ঞ ২৫ ক্যাডারের ১৩ থেকে ২২তম ব্যাচের উপসচিবগণকে পদোন্নতি প্রদানের দাবি তুলেছেন তারা। ইতিমধ্যে প্রায় ২০০ উপসচিব বিভিন্ন দাবি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসন সচিবের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন।

চিঠিতে উপসচিবরা লিখেন, সরকারের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু হলো সচিবালয়। এর মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ হলো সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য মেধাভিত্তিক দক্ষ জনসম্পদ তৈরি ও ব্যবস্থাপনা। কিন্তু মন্ত্রণালয়টি কার্যত ‘প্রশাসন’ নামক একটি ক্যাডারের স্বার্থ রক্ষার মন্ত্রণালয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে সরকারের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে ইতিপূর্বে জনপ্রশাসন সিনিয়র সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুলিপি প্রদান করা হলেও কোনো প্রতিকার মেলেনি।

পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা বলছেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এসএসবির সুপারিশের ভিত্তিতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সুপিরিয়র জনবল নিয়োগ ও পদায়ন করে থাকে। মন্ত্রণালয়ের সচিব ইহার সাচিবক দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অন্য সদস্যরা হলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, অর্থসচিব, জননিরাপত্তা সচিব, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক সচিব এবং কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল। তাদের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে সরকারের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদের জনবল। সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিবিধান অনুসরণ করে কর্মকর্তাদের মেধা, জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির সুপারিশ করা তাদের একমাত্র কাজ। পদোন্নতির জন্য তাদের সামনে থাকতে হবে কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতার তালিকা, তাদের সার্ভিস রেকর্ড এবং সংশ্লিষ্ট আইন-কানুন। প্রত্যেক ক্যাডারের আলাদা আলাদা জ্যেষ্ঠতার তালিকা থাকলেও যখন উপসচিব হিসেবে পুল সৃষ্টি হয়, তখন তাদের জন্য অনুসরণীয় একমাত্র জ্যেষ্ঠতার তালিকা হলো পিএসসি কর্তৃক নির্ধারিত মেধাতালিকা। কিন্তু এসএসবি সেই তালিকা অনুসরণ করে না; বরং প্রশাসন ক্যাডারকে ভিত্তি ধরে পদোন্নতি দিয়ে থাকে। এর ফলে কেবল প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাগণই যথাসময়ে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ এই এসএসবি কেবল একটি ক্যাডারকে প্রমোট করার বোর্ড হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কাছে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, বিষয়টি এতটাই ন্যক্কারজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হওয়ার কারণে এই এসএসবি ইকোনমিক নামক একটি টেকনিক্যাল ক্যাডারকে (যারা মাত্র ৫০০ নম্বরের পরীক্ষা দিয়ে এসেছে) সরকারের পুলভুক্ত পদসমূহে রাতারাতি পদোন্নতি প্রদান করেছে। যেমন, ২০২০ সালে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে সাবেক ইকোনমিক ক্যাডার একীভূতকালে ফিডার পদে কাজ না করে, মাঠপ্রশাসনে কোনো প্রকার অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ না দিয়েই সরকারের পুলে স্ব স্ব ব্যাচের সঙ্গে সবাইকে রাতারাতি ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে তাদের অনেকেই ফিডার পদে একদিনও কাজ না করে পর পর তিন দিনে একাদিক্রমে তিনটি ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়েছেন। এ একীভূতকরণের আগে সরকারের পুলে আসা অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা, যাদের জ্যেষ্ঠতা হরণ করে পদোন্নতিবঞ্চিত করা হয়েছে, তাদের স্ব স্ব ব্যাচের সঙ্গে জ্যেষ্ঠতার সমতা নিশ্চিত করে পদোন্নতি দেওয়া উচিত ছিল। অথচ বাস্তবতা হলো, ইকোনমিক ক্যাডার সরকারের পুলের সঙ্গে মার্জ হয়নি, মার্জ হয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে। তারা প্রশাসন ক্যাডারের পদ পেতে পারে, কিন্তু সরকারের পুলভুক্ত উপসচিব, যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদসমূহ তাদের প্রদান করে এসএসবি সব আইন-কানুন লঙ্ঘন করেছে এবং সরকারের পুলভুক্ত অন্য কর্মকর্তাদের অধিকার হরণ করেছে। এতেও প্রমাণিত হয়, এসএসবি মাত্র একটি ক্যাডার এবং সেই ক্যাডারের সঙ্গে মার্জ হওয়া কোনো ক্যাডারের পদোন্নতির বোর্ড ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এইরকম একটি একপেশে বোর্ডের কাছে রাষ্ট্র, জনগণ ও সরকারের স্বার্থ নিরাপদ নয়।

চিঠিতে আরো বলা হয়, ২৫টি বিশেষজ্ঞ ক্যাডার হতে সম্পূর্ণ মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে আগত উপসচিবগণকে পদোন্নতিবঞ্চিত করে প্রকারান্তরে সব মন্ত্রণালয়/বিভাগকে পেশাভিত্তিক ও দক্ষ জনবলের সেবা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আবার তাদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান, মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতাকে একদিকে সচিবালয়েও যথাযথভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না, অন্যদিকে স্ব স্ব ক্যাডারও তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এসএসবি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ভুল নীতি ও কর্মকাণ্ডের কারণে মেধাহীন, কোটারি, জুনিয়রদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে সরকারের সচিবালয় বা প্রশাসন ব্যবস্থা।

চিঠিতে বলা হয়, আবার যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির সময় চিত্রটি আবার একদম বিপরীত হয়ে যায়। সম্পূর্ণ মেধা এবং পেশাভিত্তিক বিশেষঞ্জ ক্যাডার হতে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণকে তাদের স্ব স্ব  প্রশাসন ক্যাডারের ব্যাচের সঙ্গে এক শতাংশকেও পদোন্নতি দেওয়া হয় না। অর্থাৎ প্রশাসন ক্যাডারের যে ব্যাচকে বিবেচনায় নেওয়া হয়, সেই ব্যাচের অন্য ২৫টি ক্যাডারের  দুই-এক জন ছাড়া কাউকেই পদোন্নতি দেওয়া হয় না, অথচ তারা মেধাতালিকার অন্তর্ভুক্ত। সর্বশেষ যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির আদেশে ২৫ ক্যাডারের সর্বসাকুল্যে ১০ শতাংশ কর্মকর্তাকে যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে—যারা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চেয়ে অনেক সিনিয়র এবং বহু আগেই যোগ্যতা অর্জন করা সত্ত্বেও বারবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে অবশেষে দৈবচক্রে পদোন্নতি পেয়েছেন। কিন্তু ১৩ থেকে ২২ ব্যাচের ৯০ শতাংশ কর্মকর্তাগণকে এখনো পদোন্নতির জন্য বিবেচনায়ই আনা হচ্ছে না। অথচ এখন প্রশাসন ক্যাডারের ২৪ ব্যাচকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির তোড়জোড় চলছে।

উল্লেখ্য, অন্যান্য ক্যাডার হতে পুলভুক্ত উপসচিবগণের পরবর্তী পদসমূহে পদোন্নতির হার আগে ছিল ৩০ শতাংশ যা কমাতে কমাতে এখন ১০শতাংশে নামিয়ে ফেলা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গোটা প্রশাসনকে কোটানির্ভর, মেধাহীন, বৈষম্যপূর্ণ ও  সিনিয়র নিষ্পেষণের হাতিয়ার বানানো হয়েছে।

চাকরিজীবীদের জন্য জ্যেষ্ঠতা কেবল পদোন্নতির অন্যতম প্রধান শর্তই নয়, এটি প্রশাসনিক শৃঙ্খলার মেরুদণ্ডও বটে। সরকারি কর্মকর্তাগণ পিএসসি কর্তৃক সুপারিশকৃত যে ব্যাচে যোগদান করেন সেটাই তাদের নিয়মিত ব্যাচ এবং পিএসসি কর্তৃক সুপারিশকৃত সম্মিলিত মেধাতালিকাই জ্যেষ্ঠতার একমাত্র ভিত্তি। জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো আইন ভঙ্গের শামিল। সৃষ্ট বৈষম্যের ফলে জ্যেষ্ঠতা হারানো ও পদোন্নতিবঞ্চিত ২৫ ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের (প্রায় ২০০ উপসচিব) বর্তমানে এক দীর্ঘ জটের সৃষ্টি করা হয়েছে। এ জট আরো দীর্ঘ করার জন্য প্রতি বছর ২৫ ক্যাডার হতে উপসচিব পদে পদোন্নতির জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়। উক্ত আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সরকারের পুলে এসে পিএসসির জ্যেষ্ঠতার ক্রম হারানো এবং বৈষম্যের শিকার হওয়া অন্যান্য ক্যাডার হতে আগত কর্মকর্তারা প্রবঞ্চনার ফাঁদে পড়েন এবং এভাবে তাদের মেধা ও ক্যারিয়ার ধ্বংস করা হয়। বছরের পর বছর এভাবেই বিনষ্ট হচ্ছে একঝাঁক মেধাবী, জ্যেষ্ঠ ও দেশপ্রেমিক জনশক্তি।

পদোন্নতিবঞ্চিত উপসচিবরা বলেন, এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, ‘যখনই কোনো কর্মকর্তা ২০০২ সনের বিধিমালা অনুসারে উপসচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হইলেন, তাহা যে কোনো ক্যাডার হইতেই হউক না কেন, তিনি তখন একজন পরিপূর্ণ উপসচিব। তাহার পূর্বের ক্যাডার পরিচয় তখন বিলুপ্ত হইবে। সচিবালয়ের উচ্চতর উপসচিব পদে তখন তিনি অধিষ্ঠান। সেই অধিষ্ঠান লইয়াই অন্য সকল উপসচিবের সহিত একশ্রেণীভুক্ত হইয়া সমঅধিকার লইয়া তিনি পরবর্তী উচ্চতর যুগ্মসচিব পদে বা পরবর্তীতে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হইবার জন্য বিবেচিত হইবেন।’

অথচ এসএসবি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ আদালতের উপরিল্লিখিত পর্যবেক্ষণও আমলে নিচ্ছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *