রিমান্ডে থাকা জিয়াউল আহসানের মুখে উঠে এলো তারিক সিদ্দিকের নাম

জাতীয়

রিমান্ডে থাকা সেনাবাহিনীর বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান গোয়েন্দাদের জেরার মুখে বলেছেন তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম। তিনি বলেছেন, তার কাছে সব ধরনের নির্দেশ আসত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের কাছ থেকে।

আট দিনের রিমান্ডে থাকা অব্যাহতিপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে গোয়েন্দা দপ্তরে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিউমার্কেট এলাকায় হকার শাহজাহান হত্যা মামলায় তাকে গত বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। হকার শাহজাহান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলেও তার বিরুদ্ধে রয়েছে খুন, গুম ও অসংখ্য ব্যক্তির ফোনে আড়িপাতার অভিযোগ। এসব বিষয়েই মূলত তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে।

প্রায় ১৫ বছর ধরে আলোচিত-সমালোচিত জিয়াউল আহসান ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তিনি সেনাবাহিনীর একজন প্রশিক্ষিত কমান্ডো ও প্যারাট্রুপার ছিলেন। এ ছাড়া দীর্ঘদিন র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে (র‌্যাব) দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৯ সালের ৫ মার্চ তিনি উপঅধিনায়ক হিসেবে র‌্যাবে যোগ দেন। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা ২০২২ সাল থেকে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভিন্নমত এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল দমন করার জন্য গুমের মতো জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ পর্যন্ত গুমের ঘটনা ঘটে। জিয়াউল আহসান গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন, এসব গুম ও গুপ্ত খুনের সঙ্গে জড়িত শেখ হাসিনার উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক। সূত্র জানান, এনটিএমসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হলেও এটির নিয়ন্ত্রণ ছিল তারিক সিদ্দিকের হাতে। তার ইশারায় চলত এনটিএমসির কার্যক্রম।

 

সূত্র মতে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জিয়াউল আহসানকে র‌্যাবের উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও তারিক সিদ্দিক এবং জিয়াউল আহসান কর্তৃক গুম-খুনের অভিযোগের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকৃতপক্ষে দেশে গুম ও গুপ্ত হত্যাগুলো মূল নিয়ন্ত্রক হলেন শেখ হাসিনার আত্মীয় ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে অসংখ্য ব্যক্তিকে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ রয়েছে। মূলত ব্যাপক পরিসরে গুমের ঘটনা শুরু হয় তার হাত ধরে। সেটি শুরু হয়েছিল ১/১১-এর পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। ওই সময় আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী, বিরোধী ঘরানার রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, সরকারবিরোধী সমালোচকসহ অসংখ্য ব্যক্তি গুমের শিকার হন। তখন দেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রায়ই বিভিন্ন ব্যক্তি গুম হয়েছেন বলে খবর ছাপা হতো। ভুক্তভোগীর পরিবারগুলো থানা থেকে শুরু করে ডিবি, র‌্যাব কার্যালয়ে ধরনা দিয়েও নিখোঁজ স্বজনের খোঁজ পেত না। এসব বিষয়ে জিয়াউল আহসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি সাফ জানান- এসব ঘটনার নেপথ্যে রয়েছেন তারিক সিদ্দিক। সূত্র জানান, গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ তৈরি করে ভিন্ন মতাবলম্বীদের তুলে নিয়ে বছরের পর বছর আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সরকার নিয়ে যারাই নেতিবাচক সমালোচনা ও সরকারের জন্য যেসব ব্যক্তির মন্তব্য এবং কর্মকান্ড হুমকিস্বরূপ ছিল তাদের তুলে নিয়ে আয়নাঘরে বন্দি করে রাখা হতো। অমানবিক নির্যাতন করা হতো। বছর দুয়েক ধরে একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে আয়নাঘরের বিষয়টি জানাজানি হয়। সেখান থেকে মুক্ত হওয়া এক ব্যক্তি বিদেশি গণমাধ্যমে তার বর্ণনা তুলে ধরেন। এর পর থেকে দেশে নিখোঁজ ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নজর ওই আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালার দিকে যায়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালানোর পর অনেক স্বজনের দাবির মুখে তিনজন বন্দিকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা। তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল। গত ৭ আগস্ট তিনি ছাড়া পান। এর আগে মুক্তি পেয়ে বাসায় ফেরেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট আহমদ বিন কাসেমকে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে এবং এর কয়েক দিন পর ২৩ আগস্ট আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে গুম করা হয়েছিল। আয়নাঘর থেকে তাদের মুক্তি দেওয়া হলেও গুম হওয়া অন্য ব্যক্তিদের পরিবার এখনো পথ চেয়ে বসে আছে কবে নিখোঁজ ও গুম হওয়া স্বজনরা ফিরে আসবেন। আবার অনেকেই ফেরার আশা ছেড়ে দিয়ে এখন বিচারের অপেক্ষায় আছেন। তারা ধরেই নিয়েছেন গুম হওয়া স্বজনরা আর বেঁচে নেই। তাদের তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

সূত্র জানান, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল ২০২২ সাল থেকে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এনটিএমসির দায়িত্বে থাকাকালীন একের পর এক কল রেকর্ড ফাঁস করেন তিনি। রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য হুমকি এমন সব ব্যক্তির স্পর্শকাতর কল রেকর্ড তার নির্দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। তিনি এমটিএমসির দায়িত্বে থাকাকালীন সরকারের এই সংস্থাটির আড়িপাতার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। এই সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তার নির্দেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মোবাইল ফোনে আড়িপাতা হতো। এর পর ওইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কল রেকর্ড সংগ্রহ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। এসব কল রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে অনেক সুশীল সমাজের লোকজনকে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *