রক্তসমুদ্রে স্বৈরাচারের পতন ♦ ছাত্রঅভ্যুত্থানে উড়ে গেল দম্ভ ♦ পালিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা

জাতীয়

রক্তসমুদ্রে গোটা দেশ ভাসিয়ে পতন ঘটল স্বৈরশাসকের। ছাত্র-জনতার তীব্র গণ আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চূর্ণ হলো দম্ভের অপশাসন। শেখ হাসিনার আচমকা বিদায়ের খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে কারফিউ ভেঙে উল্লাসে মেতে ওঠে ছাত্র-জনতা। রাজপথে নেমে আসে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ সর্বস্তরের মানুষ। স্বৈরাচারের বিদায়ে সন্ধ্যার পরও আনন্দ মিছিল চলছিল দেশজুড়ে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে চলমান অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনের ‘ঢাকা মার্চ’ কর্মসূচির মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ৩৬ দিন আগে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়ার পর দেশজুড়ে সংঘাত আর নিরীহ মানুষের মৃত্যুর মধ্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হলো।

গতকাল দুপুরে বঙ্গভবন থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে প্রথমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট যান তিনি। সেখান থেকে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদ বিমানঘাঁটিতে পৌঁছান। জানা গেছে, দিল্লি থেকে তিনি যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডন যেতে পারেন।
আন্দোলনকারী, আওয়ামী লীগ কর্মী ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোটা দেশ। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে লাশের সারিতে ভয়াবহ ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রাজধানীসহ সারা দেশে সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ৪ শতাধিক প্রাণ ঝরে গেছে। আহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২ হাজারের গন্ডি। বুলেটের আঘাতে ঝাঁজড়া হয়েছে ছাত্র-জনতার হৃদয়। রাজধানী ছাড়িয়ে বিক্ষোভের আগুন পৌঁছেছে শহর-নগর-গ্রামে।

সর্বাত্মক অসহযোগের মধ্যে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া জনতা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনও দখল করে নিয়েছে। সেখানে জাতীয় পতাকা হাতে তাদের উল্লাসের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেছেন, ‘প্রতিটি হত্যা, অবিচারের বিচার হবে। সবার চেষ্টায় দেশে শান্তি ফিরে আসবে।’ সেনাপ্রধান ছাত্র-জনতাকে ধৈর্যধারণের আহ্বান জানান।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা টানা চতুর্থ দফা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন এ বছরের ১১ জানুয়ারি। গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হন। তবে এ নির্বাচনও বিতর্কিত। এতেও প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। ছয় মাসের মাথায় ব্যাপক ছাত্র ও গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।

জানা যায়, বেলা আড়াইটায় বঙ্গভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টার শেখ হাসিনাকে নিয়ে যাত্রা করে। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, শেখ হাসিনা ঢাকা ত্যাগের আগে একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সে সুযোগ পাননি।

শেখ হাসিনার প্রথমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা যাওয়ার কথা শোনা গেলেও সূত্র জানিয়েছেন, দুই বোন প্রথমে ঢাকা থেকে পৌঁছান পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাটে। ভারত সরকার অনানুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে স্থায়ীভাবে আশ্রয় না দেওয়ার কথা জানিয়ে দেয়। তৃতীয় কোনো দেশে যাওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। পরে সে সিদ্ধান্ত অনুসারে বসিরহাট থেকে তাঁরা যান ঝাড়খন্ডে। সেখান থেকে যান ধানবাদ, তারপর কানপুর ঘুরে নয়াদিল্লির কাছাকাছি উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের হিন্দন এয়ারবেসে পৌঁছান। ভারতের গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছে, বিমানঘাঁটিতে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান এয়ার অফিসার কমান্ডিং (এওসি) সঞ্জয় চোপড়া। ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশ থেকে হিন্দন বিমানঘাঁটিতে হাসিনার বিমানের গতিবিধি সম্পূর্ণভাবে বিমানবাহিনী এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলো পর্যবেক্ষণ করে। সূত্র জানিয়েছেন, ভারতে স্বল্প সময় অবস্থানের পর লন্ডন অথবা স্কটল্যান্ডে যাওয়ার কথা রয়েছে সদ্যপদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর বোনের।

হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশছাড়ার পর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কড়া সতর্ক ব্যবস্থা নিয়েছে ভারত। এমনকি নিরাপত্তা তদারকি ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কলকাতা গিয়েছেন বিএসএফের ভারপ্রাপ্ত প্রধান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *