বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করায় প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার দেনায় ডুবেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)

জাতীয়

বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করায় প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার দেনায় ডুবেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পিডিবির বিপুল পরিমাণ বকেয়া বিল পরিশোধের জন্য টাকা এবং মার্কিন ডলার সংস্থান করা নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কয়েকটি চ্যালেঞ্জের একটি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

 

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানির বিশেষ বিধানের আশ্রয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা এ অবস্থার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। এছাড়া এ খাতে বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, অপচয় এবং অনিয়মের কারণে অন্যায্যভাবে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুতের খুচরা দাম বাড়িয়ে এবং ভর্তুকি দিয়ে সামাল দিতে না পারায় এ বিপুল পরিমাণ দেনায় ডুবেছে পিডিবি।

বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আর্থিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন বিদ্যুৎ বিভাগে জমা দিয়েছে পিডিবি। প্রতিবেদনটি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়ে অর্থনৈতিক চাপের বিষয়টি জানানো হবে। পিডিবির অপরিশোধিত বকেয়া বিলের মধ্যে রয়েছে— পেট্রোবাংলার বিভিন্ন কোম্পানির গ্যাস বিল, বেসরকারি (আইপিপি) ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল, আদানিসহ ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুৎ বিল, পায়রা ও রামপালসহ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রও পিডিবির কাছে পাওনা অর্থ চেয়ে চিঠি দিয়েছে।

দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে ক্রয়চুক্তির আওতায় বিদ্যুৎ কিনে বিতরণ সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর কাছে পাইকারি মূল্যে বিক্রি করে পিডিবি। সেই বিদ্যুৎ গ্রাহকদের কাছে খুচরা মূল্যে বিক্রি করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সমিতিগুলো, ডিপিডিসি ও ডেসকোসহ ছয়টি বিতরণ সংস্থা। এই প্রক্রিয়ায় পিডিবি যে দামে বিক্রি করে তাতে ঘাটতি থেকে যায়। আর সেই ঘাটতি সরকার ভর্তুকি দিয়ে সমন্বয় করে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দুই বছরে বেশি সময় ধরে ভর্তুকি অনিয়মিত হয়ে গেছে। ডলার ও টাকা সংকটের কারণে নিয়মিত অর্থ ছাড়তে পারছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে জ্বালানি বিল পরিশোধ এবং সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি।

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও তড়িৎ প্রকৌশলী অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, “বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এখন দেশের ‘জীবন-মরণ’ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যয় সংকোচন করে আর্থিক ঘাটতি সমন্বয় করতে হবে। উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলো এখনই বন্ধ বা স্থগিত করে জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে জোর দিতে হবে। কোনোভাবেই বিদ্যুতের-গ্যাসের দাম বাড়ানো যাবে না। এটি করা হলে জনগণের ওপর অন্যায্য ও বাড়তি চাপ তৈরি করবে।” তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতকে একটি লুণ্ঠনের খাতে পরিণত করেছে বিগত সরকার। লুণ্ঠন বন্ধ করে টেকসই উন্নয়ন করতে হবে। সে বিকল্প সরকারের কাছে রয়েছে। এ খাতকে মুনাভিত্তিক শিল্পে রূপান্তর করতে হবে। তবে এটি করতে সরকারের কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। যে পর্যন্ত ঘাটতি দূর না হচ্ছে সে পর্যন্ত ভর্তুকি অব্যাহত রাখা জরুরি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত হারে ও খোলা বাজারে বিনিময় হার ব্যবহার করে পিডিবির প্রতিবেদনে বকেয়া বিলের হিসাব করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত প্রতি ডলার ১১৭ টাকা দরে প্রতিষ্ঠানটির মোট দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৮৪৬ বিলিয়ন ডলার এবং খোলা বাজারের দর অনুযায়ী ১২৪ টাকা করে হিসাব করলে তা দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৩৫৪ বিলিয়ন ডলারে।

পিডিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, শিল্পের চাকা চালু রাখা ও জনজীবন স্বস্তিতে রাখতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা জরুরি। তাই বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি সম্পর্কে নতুন সরকারকে স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার জন্য আমরা আয়-ব্যয়ের এই তালিকা তৈরি করেছি। ঐ কর্মকর্তা আরও বলেন, দায় মেটাতে প্রতিদিন আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অন্তত ৪০ মিলিয়ন ডলার (৪ কোটি ডলার) প্রয়োজন। কিন্তু আমরা প্রতিদিন পাচ্ছি মাত্র ৫-৭ মিলিয়ন ডলার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *