টানা কয়েক সপ্তাহের ছাত্র–জনতার বিক্ষোভ, রক্তক্ষয়, দেশজুড়ে অশান্তি—এমন এক পরিপ্রেক্ষিতে সরকারপ্রধানের পদ আর দেশ দুটিই ছাড়তে হয়েছে শেখ হাসিনাকে।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গতকাল সোমবার হেলিকপ্টারে করে ভারতে চলে যান ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাও। এর পরপরই অসংখ্য মানুষ ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি আবাস গণভবনে ঢুকে পড়েন। আনন্দ–উল্লাসের পাশাপাশি চলে লুটপাটও।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এত দিন টানা দেশ শাসন করেছেন তিনি। এর আগে ১৯৯৬ সাল থেকে এক মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা।
ক্ষমতায় আসার পর এবারই প্রথম এত গুরুতর আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত। পরে ব্যাপক রক্তপাতের পর সেটা এক দফা বা সরাসরি সরকারের পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
ক্ষমতায় আসার পর এবারই প্রথম এত গুরুতর আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত। পরে ব্যাপক রক্তপাতের পর সেটা এক দফা বা সরাসরি সরকারের পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
সব মিলিয়ে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসন চলেছে। তাই তাঁর মতো একজন প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রীর এমন পতন ও দেশত্যাগের ঘটনা অবাক হওয়ার মতো বিষয় বটে।
শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছিল নজরকাড়া। একজন লড়াকু গণতন্ত্রকামী হিসেবে নিজের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন তিনি।
তবে টানা ক্ষমতার শেষের দিকে এসে শেখ হাসিনা ক্রমেই স্বৈরাচারী মনোভাবের হয়ে উঠেছিলেন বলে মনে করেন সমালোচকেরা। বিশেষ করে ভিন্নমতের কাউকে তিনি গ্রাহ্য করতেন না। একের পর এক রাজনৈতিক গ্রেপ্তার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন—সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এসবই ছিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ।
গত জানুয়ারিতে নজিরবিহীন এক নির্বাচনে জিতে চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। প্রধান বিরোধী দলগুলোর বর্জনের পরও এই নির্বাচন করায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আদালতের মাধ্যমে বারবার ‘আইনি হয়রানি করা হচ্ছে’—শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে এটা ছিল বড় একটি অভিযোগ। চলতি বছরের শুরুতে ড. ইউনূসের কারাদণ্ড হয়। তবে সমালোচকেরা মনে করেন, এই নোবেলজয়ী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।
যেভাবে ক্ষমতায় আসেন
শেখ হাসিনার জন্ম ১৯৪৭ সালে। পারিবারিক রাজনীতির উত্তরাধিকার তিনি। বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতার রূপকার, জাতির জনক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি।
ওই সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালে এক সেনা অভ্যুত্থানে বাবা–মা ও পরিবারের বাকি সদস্যদের হারান তিনি। বিদেশে থাকায় দুই বোন হাসিনা ও রেহানা বেঁচে যান।
ক্ষমতার পালাবদল ও টানা রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয় বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়েকে। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। হাল ধরেন বাবার দল আওয়ামী লীগের। তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক ক্রান্তিলগ্ন পার করছিল দলটি।
আশির দশকে তখন জেনারেল এরশাদের শাসন চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হাতে হাত ধরে গণ–আন্দোলনে নামেন শেখ হাসিনা। গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন জোরদার করেন। এর ফলে দ্রুতই গণতন্ত্রকামী জাতীয় প্রতীকে পরিণত হন তিনি।
কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয় পায়নি আওয়ামী লীগ। অপেক্ষা করতে হয় ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। অবশেষে নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। দুই দশকের বেশি সময় পর তাঁর হাত ধরেই ক্ষমতায় ফেরে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো দল আওয়ামী লীগ।
প্রথম মেয়াদে অন্তত দুটি কারণে প্রশংসিত হন শেখ হাসিনা। এক. ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি। দুই. পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা দূর করতে শান্তি চুক্তি করা।
তবে একই সময়ে বেশ কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক চুক্তি সই ও খুবই ভারতপন্থী মনোভাবের কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে শেখ হাসিনা সরকার। ২০০১ সালে বিএনপির কাছে নির্বাচনে পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ।
২০০৯ সালে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফেরে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা আবার প্রধানমন্ত্রী হন। সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ওই নির্বাচন হয়েছিল।
শেখ হাসিনা একজন পরীক্ষিত রাজনীতিক। বেশ কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়েছে তাঁকে। হামলার শিকার হয়েছেন কয়েকবার। ২০০৪ সালে ঢাকায় তাঁকে হত্যা করতে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। প্রাণে বাঁচলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর কান। এ ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে পাঠানোর জন্য আইনি লড়াইও মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে।
শেখ হাসিনার অর্জন
একসময় বাংলাদেশ খুবই দরিদ্র একটি দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে শেখ হাসিনার হাত ধরে ধীরে ধীরে সেই পরিচয় ঝেড়ে ফেলতে শুরু করে বাংলাদেশ। বিশেষত ২০০৯ সালের পর থেকে শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নজর কাড়ে সবার।
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। গত এক দশকে মাথাপিছু আয় তিন গুণ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, গত দুই দশকে আড়াই কোটির বেশি বাংলাদেশি দারিদ্র্যসীমা থেকে বেরিয়ে এসেছে।
শেখ হাসিনার আমলের অর্থনৈতিক অর্জনের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে দেশের ক্রমবিকাশমান পোশাকশিল্প। প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
সেই সঙ্গে দেশজুড়ে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে শেখ হাসিনার সরকার। নিজস্ব অর্থায়ন, ঋণ ও উন্নয়ন সহায়তার অর্থে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু।
বিতর্কের মুখে
ক্ষমতায় আসার পর এবারই প্রথম এত গুরুতর আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত। পরে ব্যাপক রক্তপাতের পর সেটা এক দফা বা সরাসরি সরকারের পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
আন্দোলন দমনে কঠোর পথ বেছে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি আন্দোলনকারীদের সরাসরি ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। পুলিশ নির্বিচার গুলি চালায়। নিহত হন কয়েক শ মানুষ। এরপর হাজার হাজার মানুষকে ফৌজদারি অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়।
তবে শুধু কোটা সংস্কারের দাবি নয়, করোনা–পরবর্তী সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জীবনযাত্রার বাড়তি ব্যয়ের কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন সাধারণ মানুষ। মূল্যস্ফীতি আকাশ ছুঁয়েছে। ব্যাপক ধস নেমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও। ২০১৬ সালের পর বিদেশি ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে।
সমালোচকেরা বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে চারপাশ থেকে এমন ভরাডুবি। এ ছাড়া কয়েক দশকের অর্থনৈতিক উল্লম্ফনের জেরে আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণেও মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মূল্য চুকিয়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছিলেন শেখ হাসিনা, এমনটাই মত বিশ্লেষক ও সমালোচকদের অনেকের।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর কর্তৃত্ববাদী দমন–পীড়নের অভিযোগ বেশ পুরোনো। অথচ এই শেখ হাসিনা একসময় বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি করে এসেছেন।
অধিকার সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় জানিয়েছে, শেখ হাসিনার আমলে (২০০৯ সালের পরবর্তী সময়ে) বাংলাদেশে অন্তত ৬০০ গুমের ঘটনা ঘটেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক।
শেখ হাসিনার আমলে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর একের পর এক আটক, নির্যাতনের অভিযোগ নতুন নয়। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
আটক, নজরদারি, হয়রানির শিকার হন মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকেরাও। গণমাধ্যমকে চেপে ধরতে শেখ হাসিনার সরকার কঠোরতর আইন করে।
পতনের নেপথ্যে
নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আদালতের মাধ্যমে বারবার ‘আইনি হয়রানি করা হচ্ছে’—শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে এটা ছিল বড় একটি অভিযোগ। চলতি বছরের শুরুতে ড. ইউনূসের কারাদণ্ড হয়। তবে সমালোচকেরা মনে করেন, এই নোবেলজয়ী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।
এ বছরের নির্বাচনের আগে বিএনপির বহু জ্যেষ্ঠ নেতাকে আটক করা হয়। আটক হন দলটির হাজারো নেতা–কর্মী। এসব কর্মকাণ্ডকে শেখ হাসিনার ভিন্ন মতামত দমনের কৌশল হিসেবে ধরা হয়।
তবে এসব অভিযোগ বরাবর অস্বীকার করে এসেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে এবং তা নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য বিদেশি সাংবাদিকেরা বাংলাদেশ ভ্রমণ করতে চাইলে কখনোই অনুমতি দেওয়া হয়নি।
এখন এসবের ফল ভোগ করতে হচ্ছে শেখ হাসিনা এবং তাঁর ৭৫ বছরের পুরোনা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে।