বিদেশে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিপুল সম্পদ

জাতীয়

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও তাঁর স্ত্রী রুখমিলা জামান চৌধুরীর নামে যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বিপুল সম্পদের খোঁজ মিলেছে। এ ছাড়া তাঁদের নামে থাকা বিদেশি ব্যাংকের হিসাবগুলোতে বড় অঙ্কের অর্থ জমা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নিয়ে এখন পর্যন্ত সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁদের পরিবারের কোনো সদস্য বিদেশে অর্থ নেননি। ফলে কীভাবে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, তাঁর স্ত্রী, পুত্র-কন্যা এবং তাঁদের নামে থাকা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করতে দেশের ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। এসব হিসাবে আগামী ৩০ দিন কোনো লেনদেন করা যাবে না। এমনকি তাঁদের নামে থাকা ক্রেডিট কার্ডেও কোনো লেনদেন হবে না। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গতকাল এক চিঠিতে এই নির্দেশনা দেয়। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও বিএফআইইউয়ের প্রধানের পদত্যাগের পর সক্রিয় হয়ে উঠেছে সংস্থাটি।

রুখমিলা জামান চৌধুরী এখন বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চেয়ারম্যান। সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ২০১৮-২৩ সাল সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে বিদেশে তাঁর বিপুল সম্পদের খবর গত নির্বাচনের আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর বিদায়ী সরকারে তাঁকে মন্ত্রী করা হয়নি।

সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও রুখমিলা জামান চৌধুরী দুজনই দেশের বাইরে আছেন বলে জানা গেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়ে গড়া সম্পদের ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে গত মার্চে এক সংবাদ সম্মেলনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেছিলেন, তাঁর বাবা ১৯৬৭ সাল থেকে লন্ডনে ব্যবসা করেছেন। তিনি নিজে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করে ১৯৯১ সাল থেকে সেখানে ব্যবসা করেছেন। এরপর তিনি যুক্তরাজ্যে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন। বিদেশে তাঁর আলাদা আয়কর নথি আছে। আর বিদেশে তাঁর যে সম্পদ আছে, তার জন্য ব্যাংকঋণ নেওয়া হয়েছে।

কোন দেশে কত সম্পদ

বিএফআইইউয়ের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২০১৪ সালে র‍্যাপিড র‍্যাপ্টর এফজিই ও ২০১৫ সালে জেবা ট্রেডিং এফজিই নামে কোম্পানি খোলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। এর মধ্যে র‍্যাপিড র‍্যাপ্টর এফজিই কম্পিউটার ও সফটওয়্যার ব্যবসা এবং জেবা ট্রেডিং এফজিই ভবন নির্মাণসামগ্রী বিক্রির জন্য নিবন্ধিত। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব রয়েছে দুবাই ইসলামিক ব্যাংক, ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের দুবাই শাখায়। এসব হিসাবে জমা রয়েছে ৩৯ হাজার ৫৮৩ দিরহাম ও ৬ হাজার ৬৭০ ডলার। সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৭ সাল থেকে গত মাস পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৬টি স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় করেছেন।

রুখমিলা জামানের নামে ২০২৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ও ৩০ নভেম্বর দুবাইয়ের আল-বারশা সাউথ-থার্ড এলাকায় দুটি স্থাবর সম্পত্তি কেনা হয়। এই সম্পত্তির মূল্য ২২ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯ দিরহাম, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা সাড়ে ৭ কোটি টাকার সমপরিমাণ।

প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক গত বছরের মার্চ মাসে দুবাই গিয়ে জানতে পারেন, দেশটিতে সম্পদ গড়ে তুলছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর পরিবার। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যয়বহুল এই বাণিজ্যিক শহরের বিজনেস বে এলাকায় তখন তাঁদের পাঁচ তারকা হোটেলের নির্মাণকাজ চলছিল।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রেও তাঁদের সম্পদের খোঁজ পেয়েছে বিএফআইইউ। ২০২১ সালের ৮ মার্চ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘টিডি ব্যাংকে’ সাইফুজ্জামান চৌধুরীর জিটিএস প্রপার্টিজ এলএলসির হিসাবে ৪৫ হাজার ৩৪০ ডলার জমা হয়। এসব অর্থ জমা হয় ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংক এবং এইচএসবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে। কিছু অর্থ যায় মার্কিন একটি কোম্পানি ক্যাপিটাল ওয়ার্ল্ড মেরিটাইম লিমিটেড থেকে।

এ ছাড়া সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান আরামিট প্রপার্টিজ এলএলসি এবং জিটিএস প্রপার্টিজ এলএলসি পক্ষে ফার্স্ট আমেরিকান টাইটেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে ১৭ লাখ ৬৫ হাজার ডলার জমা করা হয়। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট নাহার ম্যানেজমেন্ট ইনকরপোরেটেডের মাধ্যমে ২০০৫ সাল থেকে দেশটিতে বিভিন্ন সময়ে নয়টি স্থাবর সম্পত্তি কেনা হয়। এই তথ্য বিএফআইউর নথি থেকে পাওয়া গেছে। আরামিট প্রপার্টিজ এলএলসি, জিটিএস প্রপার্টিজ এলএলসি এবং নাহার ম্যানেজমেন্ট ইনকরপোরেটেড—এই তিনটিই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি।

বিএফআইইউয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আপাতত শুধু দুই দেশে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এর চেয়ে বেশি সম্পদ যুক্তরাজ্যে রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন।

গত নির্বাচনের আগে দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, একজন মন্ত্রীর বিদেশে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ ও ব্যবসা রয়েছে। পরে এই মন্ত্রীকে সাইফুজ্জামান চৌধুরী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জানা যায়, যুক্তরাজ্যে স্ত্রী রুখমিলা জামান এবং মেয়ে জেবা জামানের নামে কোম্পানি খুলেছেন সাবেক মন্ত্রী। এ ছাড়া পারিবারিক মালিকানায় থাকা ব্যবসায়িক গ্রুপ আরামিটের নামেও সে দেশে একটি কোম্পানি খুলেছেন তিনি। গত মার্চের সংবাদ সম্মেলনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী লন্ডনে ব্যবসা ও সম্পদ থাকার কথা স্বীকার করেন।

টাকার উৎস কি ইউসিবি

সরকারের পতনের পর ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংককে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন ব্যাংকের দেড় শতাধিক শেয়ারধারী। গত বৃহস্পতিবার গুলশানে ইউসিবির প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে তাঁরা এই দাবি জানান। এই সময় তাঁরা বিভিন্ন ফেস্টুন প্রদর্শন করে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ‘বিদেশে অর্থ পাচার’ ও ব্যাংকটিতে ঘটা নানা অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে ব্যাংকটির কিছু শেয়ারধারী জানিয়েছেন, রুখমিলা জামান ব্যাংকের চেয়ারপারসন হলেও কার্যত সাইফুজ্জামান চৌধুরীই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন এবং তাঁর ‘স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাটের কারণে’ ব্যাংকটি দেউলিয়া হওয়ার পথে। ওই চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে ১ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে, যা এই ‘ব্যাংকের আমানতকারীদের টাকা লুট করে পরিশোধ করা হয়েছে’। চিঠিতে আরও অভিযোগ করা হয়, ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংকটিকে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ‘অবাধ লুটপাট, আর্থিক দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার’ করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সাল শেষে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।

ইউসিবির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বাবা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে অন্যতম শেয়ারহোল্ডার পারটেক্স গ্রুপের মালিক পরিবারের সদস্যদের ইউসিবি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তখন ব্যাংকটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুখমিলা জামান। তবে রুখমিলা জামান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় ব্যাংকটি যে মূলত সাইফুজ্জামান চৌধুরী পরিচালনা করেন, তা নিশ্চিত করেছেন ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা সবাই জানে প্রভাবশালীরা অর্থ পাচার করেছে। এ জন্যই দেশে ডলার-সংকট দীর্ঘমেয়াদি হয়েছে। ব্যাংক দখল করেও অনেকে অর্থ পাচার করেছে। এখন প্রধান কাজ হলো, এই দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ অর্থ পাচার না করে। পাশাপাশি অর্থ যে দেশে গেছে, সেই দেশের সঙ্গে প্রয়োজনীয় চুক্তি করে তা ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *