ফেনীতে ভয়াবহ বন্যায়, একজনের মৃত্যু-পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।

অন্যান্য সারা বাংলা

ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। বন্যায় একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার জানান, বন্যাকবলিত মানুষকে উদ্ধার করতে সেনাবাহিনী তাদের সেনানিবাস থেকে রওনা দিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই উদ্ধার তৎপরতায় নামবে সেনাবাহিনী। তছাড়া গতকাল রাত থেকে ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উদ্ধার তৎপরতায় নেমেছেন। এই পর্যন্ত বিভিন্ন স্থান থেকে চারশত মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন মাঠে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন ও ত্রাণ বিতরণ করছেন।

টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার প্রায় দেড় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ফুলগাজী ও পরশুরামের প্রতিটি গ্রামসহ ছাগলনাইয়ার নিম্নাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।

 

মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পুরনো ভাঙা ২৬টি স্থানসহ মোট ২৭টি স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে পাল্লা দিয়ে পানি বেড়েই চলছে। পানিবন্দি গ্রামের মানুষরা নৌকা বা স্পিডবোটের জন্য অপেক্ষা করছে। একটু নিচু এলাকার বাড়ি ঘরের ছাদ পর্যন্ত পানি উঠছে। ফেনী-বিলোনিয়া সড়কে পানি ২ থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত রয়েছে। গ্রামের বিভিন্ন সড়কে পানি ৭ থেকে ৮ ফুট উচ্চতায় রয়েছে।

চলিত মাসের ১৭ তারিখ থেকে অতিমাত্রায় বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মঙ্গলবার ভোর রাতে মুহুরী ও কহুয়া নদীর পরশুরাম ও ফুলগাজীর বাঁধের ভাঙা স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে মুহূর্তেই পানি প্রবেশ করে মানুষের ঘরবাড়িতে। মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকে পানির চাপ বেড়ে ছাগলাইয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়।

ক্ষতিগ্রস্ত ফুলগাজীর সজিব জামাল জানান, চলতি বছরের জুলাই মাসে একবার ও আগস্ট মাসে দুইবারসহ ফুলগাজী ও পরশুরামে তিনবার বন্যা হয়েছে। এতে এই এলাকায় বসবাসকারীরা পড়েছে মহাবিপদে। বন্যায় অন্য সময় তারা ফসল, মৎস্যখাত, সড়ক ও বাড়িঘরের চিন্তা করলেও এই মুহূর্তে তারা জীবন বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। দুই মাসের ব্যবধানে ফুলগাজী ও পরশুরামে তিনবার বন্যা হয়েছে।

শ্রীপুরের মো. সোহেল জানান, গেল দুই বারের চেয়ে এবারের বন্যার অবস্থা খুবই ভয়াবহ। মঙ্গলবার ভোরে মানুষের বাড়ি ঘরে পানি ওঠা শুরু করে। অনেকে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে তাদের বাড়িঘরে পানি। রান্না ঘরে পানি থাকায় তারা চুলা জ্বালাতে পারছে না। অনেকেই ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে খাটের উপরে খাট রেখে কোনো রকম জীবনযাপন করছেন। দুই উপজেলার প্রায় সকল গ্রামের মানুষ পানিবন্দি আছে বলে জানা যায়।

সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকেই বিভিন্ন স্থানে আটকা পড়েছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় প্রবীণরা জানান, এই জীবনে কখনও এরকম বন্যা দেখিনি। এর আগেও বন্যা হয়েছিল কিন্তু এরকম বন্যা দেখিনি। মানুষের বাড়িঘর সম্পূর্ণ ডুবে গেছে। সড়ক দিয়ে চলাচলের ব্যবস্থাও নেই।

পরশুরামের সলিয়া এলাকার বাসিন্দা হাবিব স্বপন বলেন, আমাদের ত্রাণের চেয়েও এখন নৌকা বা স্পিডবোট বেশি প্রয়োজন। আমরা পরিস্থিতি এমন হবে বুঝতে পারিনি। তাই বাড়ি থেকে বের হইনি। এখন কোথাও যাওয়ার উপায় নাই। এ ছাড়া সোমবার রাত থেকে বিদ্যুৎ নেই। খাবার ও পানি নেই।

মুন্সিরহাট ইউনিয়নের বাসিন্দা সাহেদ হোসেন সাহেদ জানান, ফেনীর মুহুরী নদীতে পানির মাত্রা গত ৪০ বছরের ইতিহাসকে ছাড়িয়ে গেছে।

পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফরোজা হাবিব শাপলা বলেন, ‘স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় পরশুরাম উপজেলার পরশুরাম পৌরসভা ও তিনটি ইউনিয়নের প্রায় অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। গতকাল মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্য এবং স্বেচ্ছাসেবক ছাত্রদের সহায়তায় দুইটা ডিঙি নৌকা দিয়ে লোকজনকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করার জন্য সেনাবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত একজন নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। আমাদের নিকট আরও ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ৫০ টন চাল মজুত রয়েছে।’

ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া ভূইয়া বলেন, ‘উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের প্রায় অধিকাংশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। গতকাল রাত ১০টা থেকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্য এবং স্বেচ্ছাসেবক ছাত্রদের সহায়তায় দুইটা ডিঙি নৌকা দিয়ে লোকজনকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী এবং কোস্টগার্ডের সহায়তায় উদ্ধার কাজ শুরু হচ্ছে। এখন পর্যন্ত একজন মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। আমাদের নিকট আরও ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ১৮ টন চাল মজুত রয়েছে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবুল কাশেম বলেন, মুহুরি নদীর পানি বিপৎসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ১৮৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফেনী আবহাওয়া অধিদফতরের উচ্চ পর্যবেক্ষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *