প্রত্যাহার করা হচ্ছে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে করা মামলা

জাতীয়

জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করার জন্য যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেসবের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা করাসহ পাঁচটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। বিচারের প্রক্রিয়া কী হবে, তা নিয়ে আজ আইন মন্ত্রণালয়ে সভায় সিদ্ধান্ত হবে।

এ ছাড়া সন্ত্রাস দমন আইন এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করা হবে। একই সঙ্গে ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে যেসব ফৌজদারি মামলা হয়েছে, সেগুলো তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে এসব মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে বলে গতকাল রাতে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

গতকাল শনিবার সচিবালয়ে আইন ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর গতকালই প্রথম সচিবালয়ে অফিস করেন অধ্যাপক আসিফ নজরুল।

গত ১ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলনে নামেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরপর ১৬ জুলাই রংপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হন। এ ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর সারা দেশে আন্দোলন জোরদার হয়। একপর্যায়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।

ছাত্র আন্দোলন ঘিরে গত ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত সংঘাত-সহিংসতায় ৩৩১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২৪৭ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে ২৫ দিনে মোট ৫৭৮ জন নিহত হয়েছেন। ছাত্র আন্দোলন শুরু পর থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত ২৭২টি মামলা দায়েরের তথ্য পাওয়া গেছে।

সংঘাত-সংঘর্ষে নিহতের ঘটনায় আওয়ামী লীগ সরকার তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল। আবার ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে জাতিসংঘের নেতৃত্বে তদন্তের কথা বলা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ সরকারের তদন্ত কমিশন থাকবে কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের বিষয়ে এখনই তিনি মন্তব্য করতে চান না। তবে তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে জাতিসংঘের নেতৃত্বে তদন্তের কথা বলা হয়েছিল। তিনি মনে করেন, ছাত্র-জনতা দেশকে গড়ার অপূর্ব সময় তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁরা (উপদেষ্টা পরিষদ) সেই প্রত্যাশাকে প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছেন। কাজেই সেটির দিকেই তাঁদের মনোযোগ থাকবে।

আইন মন্ত্রণালয়ের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে যেসব শিশু-কিশোর মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় আটক রয়েছে, তাদেরও তিন কর্মদিবসের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

সাইবার নিরাপত্তা আইনের মামলা দ্রুত প্রত্যাহার আইন মন্ত্রণালয়ের সভায় সন্ত্রাস দমন আইন এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহারের ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস হয়। মূলত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম পাল্টে সাইবার নিরাপত্তা আইন হয়েছে। সেখানে কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনা হলেও সাইবার নিরাপত্তা আইনের বেশ কিছু ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর প্রথম মাসেই ঢাকায় মামলা হয়েছে ১৪টি। বেশির ভাগ মামলাই হয়েছে মানহানি সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে।

সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, যেকোনো ধরনের খারাপ আইন, কোনটা সংস্কার করা প্রয়োজন আর কোনটি বাতিল করা প্রয়োজন সে বিষয়ে সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন ‘সাইবার নিরাপত্তা আইনে আমিও আসামি ছিলাম। কাজেই বুঝতে পারছেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনকে ভালোবাসার কোনো কারণ নেই আমার।’

জানা গেছে, আইন মন্ত্রণালয়ের গতকালের সভায় আইন ও বিচার বিভাগের ১৬৪৩০ নম্বরে (সরকারি আইনগত সহায়তার টোল ফ্রি জাতীয় হেল্পলাইন নম্বর) ফোন করলে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার ক্ষেত্রে সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমি আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা হিসেবে আইনগত সংস্কার করে উপযুক্ত জায়গায় উপযুক্ত ব্যক্তিদের পদায়ন করে আমার মন্ত্রণালয়ের এখতিয়াধীন ব্যাপারে যা যা করার আছে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব।’

উচ্চ আদালতে বিচারকাজ বন্ধ আছে, সেটি কবে নাগাদ সচল হবে সে বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চালু করার চেষ্টা করা হবে।

সরকারের মেয়াদ নিয়ে যা বললেন

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কত দিন হবে, সে বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, মানুষের সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা ও নতুন নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে সমন্বয় করে এই সরকার যত দিন থাকা দরকার, তত দিন থাকবে। বেশিও না, কমও না। মেয়াদের বিষয়ে এখনো কোনো কথা হয়নি।

দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, একটি হলো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা থাকবে যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন দেওয়া যায়। আবার এ দেশের মানুষের যে সংস্কার-আকাঙ্ক্ষা, সেখান থেকে প্রত্যাশা থাকবে, এই সরকার যেন কিছু জরুরি সংস্কার করে যায়।

আইন উপদেষ্টা বলেন, অতীতে দেখা গেছে পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্যাতনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কিছু ভালো সেবা পাওয়া গেছে, আবার কিছু কিছু ভালো মানুষ আছেন। কিন্তু পুরো ব্যবস্থাকে এমনভাবে দাঁড় করিয়েছিল যে ভিন্নমত পোষণকারী ও মৌলিক অধিকার চর্চাকারী মানুষের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল। ফলে এগুলো সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা মানুষের আছে। নির্বাচন কমিশনসহ এসব প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন না করলে ভবিষ্যতে যে সরকার আসবে তারা তো এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবার সেভাবে ব্যবহার করবে। অতীতের অভিজ্ঞতা সুখকর না।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে কি তাহলে পদত্যাগ করতে বলবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না। আমি শুধু বলেছি, সব সংস্কার করা হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *