গোয়েন্দা কাজের ইতিহাসবৃত্তঃ ফিলিস্তিন ও হামাস প্রসঙ্গ

আন্তর্জাতিক

এ কে এম রাশেদ শাহরিয়ার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের কবুতর গোয়েন্দা বাহিনী ছিল। যার নাম দেয়া হয়েছিল “সিক্রেট পিজন সার্ভিস”। এই কবুতর বাহিনী এক হাজারের বেশি সংবাদ নিয়ে ফিরে এসেছিলো। জার্মানদের রাডার স্টেশন ও রকেট ছোড়ার স্থাপনা সম্পর্কেও এই কবুতরদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে।

১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন কবুতর, কাক, ও ডলফিন গুপ্তচর হিসাবে ব্যবহার করত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। লেনিনগ্রাদের কাছে রাশিয়ার সবচাইতে শক্তিশালী সাবমেরিন তৈরি করতো এমন এক বন্দরকে নির্বাচিত করা হয়েছিলো গুপ্তচর কবুতরদের মিশনের জন্য।

কিন্তু এর পর থেকে এই কবুতরেরা কতগুলো সফল মিশনে গেছে, আর তা থেকে কী ধরনের গোপন তথ্য মিলেছে, সে সম্পর্কিত নথিপত্র এখনো গোপনই রয়ে গেছে।

মীরজাফর জুতার মধ্যে সেলাই করে ইংরেজদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন পলাশী ট্রাজেডির ষড়যন্ত্রের সময়।

পারস্য সম্রাট দারায়ুস মিলেটাস নগরীর শাসন থেকে হিস্টেইয়াসকে অব্যাহতি দিয়ে তার প্রধান উপদেষ্টা মেগাবিজুসের পরামর্শে সুসা (বর্তমানে ইরানে অবস্থিত, শহরটির পূর্বে টাইগ্রিস নদী) নিয়ে যায়। আর মিলেটাস নগরীর নতুন শাসক হিসাবে নিযুক্ত করেন আরিস্টগোরাসকে আরিস্টগোরাস সম্পর্কে হিস্টেইয়াসের ভাগ্নে এবং মেয়ে জামাই।

হিস্টেইয়াস ছিলেন গ্রিক রাজা। সম্রাট দারায়ুসকে সিথিয়া অভিযানের সাহায্য করেছিলেন।

হিস্টেইয়াস মিলেটাসেই ফিরে যেতে চাইছিলেন। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি পরিকল্পনা করলেন। মিলেটাসে যদি বিদ্রোহ করানো যায়, তাহলে সম্রাট দারায়ুস নিজেই হিস্টেইয়াসকে মিলেটাসে পাঠাবেন তা নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু সেই বিদ্রোহ কিভাবে করানো সম্ভব?

এই দিকে সম্রাটের প্রধান উপদেষ্টা মেগাবিজুস হিস্টেইয়াসকে সন্দেহ করতেন, তাই হিস্টেইয়াসকে সব সময় নজরবন্দী রাখতেন।

হিস্টেইয়াস তার দাসের চুল কামিয়ে মাথায় উল্কি করে নিজের গোপন সংবাদ লিখলেন। দাসের মাথায় চুল ওঠার পর কোনোরকম চিঠি পত্র ছাড়াই মিলেটাসে পাঠালেন। পারসিক সেনারা তাকে তন্ন অন্ন করে খুঁজেও তার কাছথেকে  কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। আর তারা ভাবতেও পারেনি চুলের নিচে লুকিয়ে আছে গোপন সংবাদ। সময় মতই দাস চলে গেলেন দরবারে

দাস জানালেন তার অদ্ভুত ইচ্ছা।  আরিস্টগোরাসকে বললেন। আপনার শ্বশুর আমার মাথা কামানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ধারণা করা হয় দাসটি বোবা ছিল।

আরিস্টগোরাস দেখলেন চুলের নিচে নির্দেশ নামা। নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে অ্যান্সেবাসী দের সাহায্যে পরিকল্পিত বিদ্রোহ তৈরি করেন। এই বিদ্রোহের নাম আয়োনিয়ান বিদ্রোহ। হিস্টেইয়াসের পরিকল্পনা সফল হয়। সম্রাট দারায়ুস বিদ্রোহের কথা জানামাত্রই হিস্টেইয়াসকে মিলেটাসে পাঠান। হিস্টেইয়াস সার্দিস শহর হয়ে যাওয়ার পথে সেখানকার রাজা আর্টাফেরনেস ধরতে পারেন এই বিদ্রোহের মূলত হিস্টেইয়াসের পরিকল্পনা। হিস্টেইয়াস প্রাণভয়ে চিয়স দ্বীপে পালায়। মিলেটাস এসে শাসনভার নিতে চাইলে সাধারণ মিলেটিয়ান জনগণ তাকে লেসবসে তারান। হিস্টেইয়াস পালিয়ে কৃষ্ণসাগরে জলদস্যুগিরি করে, কিছুদিন পর পারস্যের কিছু অঞ্চলে হামলা চালিয়ে ধরা পড়ে গর্দান হারায়।

নির্দয় চেঙ্গিস খান উত্তর চিন জয়ের পর তার প্রযুক্তিবিদদের গলায় অস্ত্র ধরে তাদের কৌশলকে কাজে লাগিয়ে জয় করেন চিনের দক্ষিণাংশ। চেঙ্গিসের এই জয়ের পর, মুসলিম সাম্রাজ্য খ্বারাজিম সাম্রাজ্যের শাসক আলাউদ্দিন মুহম্মদ (তার পিতা সেলজুক শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, আফগানিস্তান, পার্সিয়া ও তুর্কিস্তানে খারেজমিয়ান সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন।) আর মহম্মদের স্বপ্ন ছিল পশ্চিমে বাগদাদ দখল করে পুরো পৃথিবী ব্যাপী একক মুসলিম সাম্রাজ্য গড়ে তোলা। মুহম্মদ চেঙ্গিসের চীন বিজয়ের কথা জানার পর, তার সাথে সন্ধিপ্রস্তাবের উদ্দেশ্যে এক দল সৈন্য দূত হিসাবে পাঠান, আর প্রচুর উপহার সামগ্রী।

ওইদিকে বাগদাদের আব্বাসি খালিফা নাসির সেও আশা করছিলেন, কারা-খিতাই সাম্রাজ্যের দমনের প এশিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নেস্টোরিয়ানবাদ খ্রিস্টানদের ভূমিগুলো  মোঙ্গলরা দখল করে নিয়েছিল। তাই খালিফার বিশ্বাস হয়েছিল চেঙ্গিস নিশ্চয়ই খ্রিস্টান বিরোধী। এই নবোত্থিত শাসক নিশ্চয়ই দ্বিতীয় মুহম্মদের হাত থেকে তাঁদের রক্ষা করবে। তাই ভেবে চেঙ্গিস খানের কাছে পাঠালেন গুপ্তচর, কিন্তু সমস্যা হল বাগদাদ থেকে মোঙ্গলিয়ায় যেতে পার হতে হবে খ্বারাজিম সাম্রাজ্য, আর মুহম্মদ জানতে পারলে তাঁর সাথে চেঙ্গিস খানের সন্ধি কিছুতেই হতে দেবে না।

বাগদাদের আব্বাসিয় খালিফা নাসির গুপ্তচরের মাথা কামিয়ে, গরম লোহা দিয়ে খালিফা নিজের চিহ্ন এঁকে নীল রঙ ঘষে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন মঙ্গল সাম্রাজ্যে। এই কৌশলটি সেই পুরানো গ্রীকদের  কৌশল। হয়ত খালিফা গ্রীক দর্শন ও ইতিহাস জানতেন। খ্বারাজিম সাম্রাজ্য নিরাপদে অতিক্রম করে সেই গুপ্তচর মোঙ্গলে এসে পৌঁছাতেই চেঙ্গিস বাহিনীর হাতে পড়ল। চেঙ্গিস খান পর্যটক–ব্যবসায়ীদের ভালো আপ্যায়ন ও যত্ন করতেন তাদের থেকে সে দেশের সকল খবরাখবর নিতে।

পশ্চিমে মুহম্মদই যে শুধু মুসলিম শাসক নয় বাগদাদেও আছে আর তাদের মধ্যে যে সৌহাদ্র্য নেই তা চেঙ্গিস খানকে আনন্দিত করল। খালিফার নাসিরের সন্ধি ও সমস্যার বিষয়ে চেঙ্গিসের কোন মনোযোগ ছিলো না, তার কাছে মুহম্মদের সাথে করা বাণিজ্য চুক্তিই খুব বেশি লোভনীয়।

মোসাদের খুব সীমিত জনশক্তি এবং সংস্থান রয়েছে,

নিজেদের ঘিরে চলমান রহস্যকে জিইয়ে রাখতে সাফল্যের গল্পগুলোই বেশি ছড়িয়ে দেয় তারা। কিন্তু তাদের আছে পলিটিকাল একশন এবং লিয়াজো বিভাগ, আর এসবের জন্য তৈরি কিছু সফলতা।

ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে চার ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ইরান। এর আগে ইরানের পরমাণু কেন্দ্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র চুরির দাবি করে ইসরায়েল, যে দাবিকে মিথ্যা বলেছে ইরান।

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির মৃত্যু একটি হত্যাকাণ্ড পাইলটই ইসরাইলের গুপ্তচর এজেন্টদের একজন।

১৯৯৭ সালে মোসাদের অপারেশনে হামাসের প্রধান খালিদ মিশালকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করতে গিয়ে ইসরায়েলের দুই ভুয়া পাসপোর্টধারী এজেন্ট জর্ডানে ধরা পড়ে। খালিদ তার গাড়ি হতে নেমে হামাস অফিসে প্রবেশের সময়ে হাতে ব্যান্ডেজ লাগানো তিন কানাডীয় টুরিস্ট তার গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো, তারা ছিল মোসাদের স্পাই। এক টুরিষ্ট  হঠাৎ খালিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, কানের নিচে একটা পুশ করে বিষ ঢুকিয়ে দেয়। হাসপাতালে ভর্তি করা হলো খালিদকে, অবস্হা ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে, গুঞ্জন ওঠে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হবে খালিদের। হামাস এবং ইসরাইলের সাথে তখন সুসম্পর্ক ছিলো জর্ডানের। জর্ডানের বাদশাহ হোসাইন সরাসরি ফোন করে নেতানিয়াহুকে। এই নেতানিয়াহুই তখন ক্ষমতায়। বাদশার হুমকি, “যদি খালিদ মিশাল মারা যায় তাহলে মোসাদ স্পাইদের হত্যা করা হবে,” সাথে সাথে শান্তি চুক্তি বাতিল হবে ইসরাইলের সাথে। হুমকিতে মোসাদের চীফ নিজেই ল্যাবরেটরীতে মডিফাই করা বিষের প্রতিষোধক নিয়ে আম্মানে আসেন। সুস্হ হয়ে ওঠেন খালেদ মিশাল। এই ব্যর্থ হামলার ফলাফল এমন করুন ছিলো যে, মোসাদের চীফকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। মনে করা হয় এই হামলায় কানাডার গোয়েন্দা সংস্হা (csis) জড়িত।

হামাসের আকর্ষিক ও বিস্ময়কর আক্রমণের মুখে ব্যর্থ ইসরায়েল ও মোসাদ গোয়েন্দারা।

রয়টার্সকে হামাসের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র বলেছে, হামাস কয়েক মাস ধরেই ইসরায়েলকে বিভ্রান্ত করার জন্য একটি অভূতপূর্ব গোয়েন্দা কৌশল ব্যবহার করেছে। হামাস ইসরায়েলকে ধারণা দিয়েছিল যে তাঁরা লড়াইয়ের জন্য একদমই প্রস্তুত নয়। কিন্তু আড়ালে তারা ব্যাপক অভিযানের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে, দুই বছরে। এমনকি এই দুই বছর ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সামরিক নিপীড়ন ঠিকই চলেছে কিন্তু এরপরও হামাস কোনো পপ্তিক্রিয়া দেখায়নি। আর তা কেন দেখায়নি? তা বলার আর প্রয়োজন নেই।

হামাস এতটাই সংগোপনে এই হামলার পরিকল্পনা করেছে যে তাদের গোষ্ঠীটির প্রথম শ্রেণীর অনেক নেতাও এই হামলার বিষয়ে জানতেন না।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *