মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় বৃষ্টি হয়নি। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। প্লাবিত এলাকা থেকে নামতে শুরু করেছে পানি। পানি নেমে যাওয়া নিজের আবাসস্থলে ফিরে আসতে পেরে শত কষ্টের মধ্যেও মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। কারণ বন্যার পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। পাহাড়ি ঢল ও ভারি বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট এ বন্যার পানি যত কমছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।
গত বৃহস্পতিবার ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি হয়ে সৃষ্ট নদী ভাঙনের পানির স্রোতের তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর, সড়ক, কালভার্টসহ বিধ্বস্ত বিভিন্ন অবকাঠামো পানি নেমে যাওয়ায় ক্ষত চোখে পড়তে শুরু করেছে।
এ ছাড়া কৃষকের বীজতলা, ফসলের মাঠ, মাছের ঘের, বেড়িবাঁধ, বসতঘর যেন বন্যার ক্ষতের চিহ্ন বহন করছে। তবে পানি নামলেও দুর্ভোগের শেষ নেই বন্যাদুর্গতদের। গবাদি পশু ও শিশুদের খাদ্যের সংকটের পাশাপাশি সুপেয় পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে কোথাও কোথাও। এ ছাড়া পানি নামতে শুরু করার পাশাপাশি নানা রোগের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
এদিকে যারা আশ্রয়কেন্দ্রে কিংবা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে উঠেছিলেন, তারা এখন ফিরছেন নিজ বাড়িতে। তাদের কেউ কেউ ছুটছে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামতের অর্থ জোগাড়ে, কেউ চিন্তিত চাষের জন্য বীজ-সার নিয়ে, আবার কেউবা পরিবারের সদস্যদের খাবার জোগানো নিয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন।
শনিবার কমলগঞ্জ বৃষ্টিপাত হয়নি। সারা দিন ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। সে কারণে স্বস্তি ফিরেছে মানুষের মনে।
জানা গেছে, কমলগঞ্জ উপজেলার বুক চিরে প্রবাহিত ধলাই নদীতে গত বৃহস্পতিবার বৃষ্টি ও উজানের ঢলে ধলাই নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে ইসলামপুর ইউনিয়নের কুরমাঘাট চেকপোস্ট এলাকায় দুটি ও মকাবিল এলাকায় দুটি ভাঙন, আদমপুর ইউনিয়নের কাটাবিল, রহিমপুর ইউনিয়নের বড়চেগ, মুন্সিবাজার, মাধবপুর এলাকার প্রতিরক্ষা বাঁধের প্রায় ১৪টি স্থানে ভাঙন দিয়েছিল।
ভাঙন দিয়ে পানি প্রবেশ করেছে ইসলামপুর, আদমপুর, মাধবপুর, শমসেরনগর, পতনউষার, মুন্সিবাজার, কমলগঞ্জ সদর ও কমলগঞ্জ পৌরসভার প্রায় ১৪৫টি গ্রামসহ নিম্নাঞ্চলের বসতভিটা ও রাস্তাঘাট। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দ্বি হয়ে পড়েছিল। অনেকেই বাড়িঘর ফেলে প্রাণ নিয়ে ছোটেন আশ্রয়কেন্দ্রে ও উঁচুস্থানে বসবাসকারী আত্মীয়ের বাড়িতে।
শনিবার বৃষ্টিপাত না হওয়া ও উজানের ঢলের পানি না নামায় কমতে থাকে ধলাই নদীসহ বিভিন্ন ছড়ার পানি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, ধলাই নদীর পানি শনিবার সকাল ৯টার দিকে ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার ১০২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
জানা গেছে, উপজেলায় পানির তোড়ে প্রায় শতাধিক বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত হয়েছে ইসলামপুরের উত্তর গোলের হাওড়, কানাইদেশী, বনগাঁও ও কোনাগাঁও গ্রামে। বনগাঁও গ্রামের সুন্দর মিয়া বলেন, স্ত্রী সন্তানসহ ৫ জনকে নিয়ে ঘরটিতে বসবাস করছিল। বন্যার পানি তোড়ে ঘরটি ভেঙে গেছে। জয়নাল মিয়া বলেন, পরিবারে ৪ সদস্য নিয়ে বসবাস করছিল। ঘরটি ভেঙে যাওয়ায় এখন খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে।
বন্যাদুর্গত মাছুম মিয়া বলেন, বন্যায় সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ঢলের স্রোতে এবং ঢেউয়ে ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে। এখন এগুলো কীভাবে মেরামত করব, সেই চিন্তায় আছি।
বন্যাদুর্গত সাজিনা বেগম বলেন, বন্যায় আমাদের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই, যেন আমাদের ঘর থাকার উপযোগী করতে সহায়তা করে।
জানা গেছে, কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর-আদমপুর, কমলগঞ্জ-মাধবপুর, কমলগঞ্জ-মৌলভীবাজার, কমলগঞ্জ-আলীনগর সড়ক, পাত্রখোলা-ভান্ডারীগাঁও, মাধবপুর-কাটাবিল রাস্তা ভেঙে গেছে। বন্যার পানিতে সড়ক ও জনপথের প্রায় ৪০ কিলোমিটার সড়ক পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে সড়ক পথে স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে।
বন্যায় সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর জমির আমন ও আউশ ধান তলিয়ে গেছে। ১ হাজার হেক্টর জমির সবজি তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকরা।
মকাবিল গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, তিনি ৬ হেক্টর জমিতে বর্গা চাষ করছিলেন। বন্যায় সম্পূর্ণ ভেসে গেছে। এখন লগ্নিকৃত টাকা কিভাবে জোগার করবো তাই নিয়ে চিন্তায় আছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার রায় বলেন, ৮ হাজার হেক্টর আউশ ও আমন ধান বিনষ্ট হয়েছে। উপজেলায় বন্যার পানিতে প্রায় ৪ হাজার মাছের ফিসারি ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।
মৎস্য কর্মকর্তা জানান, ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এখনো সঠিক হিসাব করা হয়নি। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, উপজেলার প্রায় ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে নিমজ্জিত।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, উপজেলার পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা কমে প্রায় ১০ হাজারে নেমে এসেছে। যেসব এলাকায় বাড়ির আঙিনা থেকে পানি নেমেছে, সেখানে কাদায় সয়লাব থাকায় ঘর থেকে বের হতে দুর্ভোগে পড়ছে মানুষ। গবাদি পশু ও শিশুদের খাদ্যের সংকটের পাশাপাশি সুপেয় পানির ও সংকট রয়েছে। সরকারিভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ বণ্টন করা হয়েছে। যা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, কমলগঞ্জ উপজেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারিভাবে ৬০ মে. টন জিআর চাল ও শুকনো খাবার বিতরণের জন্য নগদ সাড়ে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জয়নাল আবেদীন বলেন, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। প্রয়োজনীয় এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যার সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। বরাদ্দ এসেছে, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে শুকনো খাবার বিতরণও শুরু হয়েছে।