এখনো পানিবন্দি মানুষ, লক্ষ্মীপুরে অপরিবর্তিত বন্যা পরিস্থিতি, ১১ জেলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৪

অন্যান্য সারা বাংলা

বন্যা আক্রান্ত এলাকাগুলো থেকে পানি কমছে। ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। ভেঙে পড়েছে গ্রামীণ সড়ক কাঠামো। তৈরি হয়েছে ছোট-বড় গর্ত। চলমান বন্যায় মাছের ঘের ও রোপা আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রাঙামাটিতে এখনো পানিবন্দি মানুষ। অপরিবর্তিত রয়েছে লক্ষ্মীপুরের বন্যা পরিস্থিতি। দুর্গম এলাকায় পৌঁছেনি ত্রাণ। ফেনীর অনেক এলাকায় এখনো পানি রয়েছে। রয়েছে দুর্গম এলাকায় ত্রাণ না পৌঁছার অভিযোগ।

এদিকে দেশের ১১টি জেলায় আকস্মিক ভয়াবহ বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ জনে। সবচেয়ে বেশি ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে ফেনীতে। দুর্গত এলাকাগুলোয় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ১০ লাখ ৯ হাজার ৫২২টি পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা অন্তত ৫৪ লাখ ৬৪ হাজার ১৬৭ জন। গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারের ৬৪টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন বা পৌরসভার সংখ্যা ৪৮৬টি।

 

বন্যায় এখন পর্যন্ত ফেনীতে ১৯ জন, কুমিল্লায় ১৪ জন, চট্টগ্রামে ৬ জন, খাগড়াছড়িতে ১ জন, নোয়াখালীতে ৮ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ জন, লক্ষ্মীপুরে ১ জন, কক্সবাজারে ৩ জন এবং মৌলভীবাজারে ১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে; নিখোঁজ রয়েছেন একজন।

মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে পানিবন্দি-ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য দুর্গত এলাকাগুলো ৩ হাজার ২৬৯টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৬৮৭ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া ৩৮ হাজার ১৯২টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে এসব এলাকায় ৫৬৭টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।

উজানের তীব্র ঢল এবং অতি ভারী বৃষ্টির কারণে গত ২০ আগস্ট থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব, পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। এতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে, সেই সঙ্গে বেরিয়ে আসছে বন্যার ক্ষতচিহ্ন।

সব নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে : বৃষ্টিপাত কমে দেশের প্রধান প্রধান নদনদীর পানি সমতল বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মাসহ অধিকাংশ নদনদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা না থাকায় এসব অঞ্চলে নদনদীর পানি সমতল আরও হ্রাস পেতে পারে।

নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

চট্টগ্রাম :  চট্টগ্রামে বন্যাকবলিত এলাকা থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন। ভেঙে পড়েছে গ্রামীণ সড়ক কাঠামো। সড়কে তৈরি হয়েছে ছোট-বড় গর্ত।

জানা যায়, চট্টগ্রামে এবারের বন্যায় বেশি প্লাবিত হয় মিরসরাই ও ফটিকছড়ি উপজেলায়। মিরসরাইয়ের করেরহাট, কাটাছরা, দুর্গাপুর, মিঠানালা, ধূম, হিঙ্গুলী, ওচমানপুর, নাহেরপুর, বাংলাবাজার, মোবারক ঘোনা, কাটাগাং, খৈয়াছরা, মায়ানী, মঘাদিয়া, ইছাখালী এলাকা কয়েক দিন পানির নিচেই ছিল। বানভাসিরা আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। আশ্রয় কেন্দ্র থেকে নিজ বাড়িতে এসে দেখছেন ভয়াবহ চিত্র। গ্রামীণ সড়কগুলোও খানাখন্দে ভরপুর।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর মিরসরাই উপজেলা প্রকৌশলী রনি সাহা বলেন, মিরসরাইয়ে বন্যায় গ্রামীণ সড়কগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। এর মধ্যে ১১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ৫৪টি সড়ক এবং ২৫টি ছোট-বড় সেতু ও কালভার্ট নষ্ট হয়ে যায়। তবে তালিকাটি এখনো অসম্পূর্ণ। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহফুজা জেরিন বলেন, এখানকার সবকটি ইউনিয়ন পানিতে তলিয়ে যায়। তবে গত কয়েকদিন ধরে পানি নামতে শুরু করলে সবাই নিজ বাড়িতে আসতে শুরু করে। এর মধ্যে অনেকের ঘর বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তাছাড়া গ্রামীণ সড়কগুলোর ক্ষত এখন ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে।

বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয় ফটিকছড়ি উপজেলায়। এই উপজেলার সুন্দরপুর, হারুয়ালছড়ি, নাজিরহাট পৌরসভা, সুয়াবিল, দাঁতমারা ও ভূজপুরে বেশি প্লাবিত হয়। ফলে এখানকার সড়কগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এ উপজেলার ২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ৮১টি সড়ক, ১৮টি সেতু ও ১৩৬টি কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ইতোমধ্যে আমরা ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছি। এর মধ্যে সড়ক, কৃষি ও মৎস্য খাতে বেশি ক্ষতি হয়। সড়কগুলো দ্রুত মেরামতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের প্রায় ৯টি উপজেলায় বন্যা হয়। এর মধ্যে ফটিকছড়ি, মিরসরাই ও হাটহাজারী উপজেলা তুলনামূলক বেশি প্লাবিত হয়। তবে গত রবিবার থেকে বন্যা পরিস্থিতি আস্তে আস্তে উন্নতি হতে থাকে। ফলে ক্রমেই ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। বন্যায় ফটিকছড়িতে তিনজন, হাটহাজারীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একজন ও রাঙ্গুনিয়ায় পানিতে ডুবে একজন মারা যান। তাছাড়া বন্যায় চট্টগ্রামে মিরসরাই, ফটিকছড়ি ও সাতকানিয়া উপজেলার ৩৩টি ইউনিয়নের ৫৮ হাজার ৪৩৮টি পরিবারের ২ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নোয়াখালী : গত দুই দিনে তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে, পানি কমতে শুরু হয়েছে। এদিকে পাকা সড়কগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দীর্ঘদিন পানির নিচে থাকায় গ্রামীণ সড়কগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে গর্ত হয়ে যাওয়ায় চলাচল ও যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। তবে কিছু এলাকায় এখনো পানি আগের অবস্থায় রয়েছে। পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকটে রয়েছে। দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট এবং ডায়রিয়ার প্রকোপ।

অন্যদিকে সাপের উপদ্রবে নাকাল দুর্গম এলাকার বন্যাদুর্গতরা। অনেকের কাটছে নির্ঘুম রাত। কিছু দুর্গম এলাকার আশ্রয়ণ কেন্দ্রগুলোতে এখনো ত্রাণ পৌঁছেনি বলে অনেকে জানিয়েছেন।

জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাছুম ইফতেখার জানান, সিভিল সার্জন অফিসের পক্ষ থেকে একটি মেডিকেল টিম মাঠে রয়েছে এবং পর্যাপ্ত ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।

রাঙামাটি : এখনো পানিবন্দি পাহাড়ের মানুষ। ডুবে আছে হাজারো বসতঘর, দোকানপাট, ফসলি জমি ও সড়ক। সড়কপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর চলাচলে একমাত্র মাধ্যম এখন একমাত্র নৌকা কিংবা ক্যান্ট্রি বোট। এমন চিত্র এখন রাঙামাটির দুর্গম উপজেলা বাঘাইছড়ি, লংগদু, জুরাছড়ি,  বিলাইছড়ি, নানিয়ারচর ও বরকলে। খাবার, পানি ও ওষুধ সংকটে ভোগান্তি চরমে এসব বানভাসি মানুষের।

হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জে বন্যায় মাছের ঘের ও রোপা আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় এখন ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। বন্যার পানিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মৎস্য খামারি ও রোপা আমন ধানের চাষিরা। বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে দেড় হাজার জলাশয়ের কোটি কোটি টাকার মাছ আর পানির নিচে থেকে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর রোপা আমন। এমতাবস্থায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

ফেনী : ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতির দিকে। জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন এখনো ৪৪১টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৬৬ হাজার ২৮২ জন আশ্রিত রয়েছেন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ১৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা বন্যা চলাকালীন বিভিন্ন সময় মৃত্যুবরণ করেছেন। বন্যায় জেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষ দুর্যোগের শিকার  হয়েছেন। এখনো শহরের পেট্রোবাংলা, মধুপুর, বিরিঞ্চি, মাস্টারপাড়া লমী হাজারী বাড়ি সড়ক, পানিতে তলিয়ে আছে। অন্যান্য পাড়া থেকে পানি অনেকটা নেমে গেছে। সদর উপজেলার মোটবি, পাঁচগাছিয়া, ফাজিলপুর, ধর্মপুর ও ফরহাদ নগরের মানুষ এখনো পানিবন্দি রয়েছে। দাগনভূঞার পূর্বচন্দ্রপুরসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি দশা থেকে এখনো মুক্তি পায়নি। অন্যান্য উপজেলার নিম্নাঞ্চল এখনো পানির নিচে রয়েছে।

মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারে চলমান বন্যায় পানিতে ভেসে গেছে ৩ হাজার ১টি পুকুর থেকে ১৫৩৫ মেট্রিক টন মাছ। এতে সাত উপজেলা মিলিয়ে মৎস্যসম্পদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা।

চলতি বন্যায় জেলাজুড়ে ২৬৬ হেক্টর পরিমাণ পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বানের পানিতে। পানি উপচে বন্যার পানির সঙ্গে ভেসে গেছে পুকুর, জলাশয়ের প্রায় ১৫৩৫ টন মাছ। ভেসে গেছে ৩ হাজার ১টি পুকুর।

লক্ষ্মীপুর : ১০ দিনেও পানি নামেনি লক্ষ্মীপুরের বন্যাকবলিত এলাকায়। উলটো থেমে থেমে বৃষ্টিতে প্লাবিত হচ্ছে জনপদ। শহর কিছুটা সুরক্ষিত থাকলেও অন্তত ১০০ গ্রাম এখনো পানির নিচে। এসব এলাকায় পৌঁছেনি পর্যাপ্ত খাদ্যসহায়তাও। যাতে চূড়ান্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন মানুষ। তাদের প্রত্যাশা, দ্রুত খাবার, সুপেয় পানিসহ অন্যান্য সহায়তার। সরেজমিনে সদরের দিঘলি, ভাঙ্গা খা, চরশাহী, লাহারকান্দি ও দক্ষিণ হামছাদি ঘুরে দেখা গেছে পানির ওপর ভাসছে ঘর। খড়কুটোর মতো চলছে জীবন-জনপদ।

খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়িতে  স্মরণকালের  ভয়াবহ বন্যায়  বাড়িঘর যেমন ডুবেছে,  ঠিক তেমনি ফসলি জমি, সড়ক, ব্রিজ, কালভার্টের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় পাঁচটি উপজেলা ডুবলেও সড়কের ক্ষতি হয়েছে ৯টি উপজেলায়। জেলার পাঁচটি উপজেলা চেংগী ও মাইনি নদীর পানিতে ডুবেছে। এগুলো হলো- খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা, পানছড়ি, রামগড় ও মাটিরাঙ্গা।  বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। পৌর শহরের শান্তিনগর, শব্দ মিয়াপাড়া, মহিলা কলেজ সড়ক, গোলাবাড়ী ইউনিয়নের গঞ্জপাড়া, ঠাকুরছাড়া, উল্টরগঞ্জপাড়া.  মেরুংয়ের অনেক সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *