আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে বেরিয়ে আসবে জুলাই গণহত্যার সত্য

জাতীয়

কোনো গণহত্যার ওপর সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করতে গেলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্যের প্রয়োজন হয় সেটি হলো মৃতের সংখ্যা। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ১৬ থেকে ২১ জুলাই সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা হয়। এসময় যে গণহতাহতের ঘটনায় সঠিক মৃত্যুর সংখ্যা পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে গিয়েছে। এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু বিষয়।

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে বেশ কয়েকদিন ধরে দেশজুড়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এ কারণে মোট মৃত্যুর সংখ্যা বের করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

যেহেতু মৃত্যুর তথ্য চিকিৎসকের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হয় তাই হাসপাতালগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে।

১৬-২১ জুলাইয়ে মৃত্যুর সংখ্যা এত বেশি ছিল এবং এত বিচ্ছিন্নভাবে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় হয়েছিল যে কারণে মৃত্যুর তথ্য বের করা বেশ কঠিন হয়ে যায়।

এর মধ্যে কারফিউ ও ইন্টারনেট শাটডাউনের কারণে তথ্যগুলো পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যায়।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আন্দোলনের সময় শুধু রাজধানী ঢাকাতেই ৩০টির বেশি ভিন্ন ভিন্ন হাসপাতাল রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছে বা মৃতদেহ গ্রহণ করেছে।

তবে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে সামনে আসে গণমাধ্যমের কাছে সঠিক মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশ না করতে সরকারের কঠোর নির্দেশ।

গত ১৮ থেকে ১৯ জুলাই পূর্ব রামপুরা এলাকায় ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, আহতদের মধ্যে শতাধিক মানুষকে ওই এলাকায় অবস্থিত বেটার লাইফ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

২৪ জুলাই বেটার লাইফ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসক শুভ্রজিৎ সরকারের কাছে আন্দোলনে সহিংসতা চলাকালে হাসপাতালে আসাদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো রোগী মারা যায়নি। কয়েকজন চিকিৎসা নিয়েছেন।’

অন্যদিকে জরুরি বিভাগের নার্স প্রসেনজিৎ মধু দেন ভিন্ন তথ্য। তিনি বলেন, তারা এক হাজারেরও বেশি আহতকে চিকিৎসা দিয়েছেন। ১২ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন তিনি, যাদের মৃত অবস্থায়ই হাসপাতালে আনা হয়েছিল।

এর প্রায় এক সপ্তাহ পরে দ্বিতীয়বারের মতো হাসপাতালটিতে যান এই প্রতিবেদক।

এসময় হাসপাতালটির জরুরি বিভাগের আরেক চিকিৎসক রাজীব পার্থ বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের পুরো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কোনো সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলতে। একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ডিবি, এনএসআই থেকেও। লোকজন আমাদের ওপর নজর রাখছে। আজও এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ পুলিশ) থেকে লোক এসেছে। মিডিয়াকে কোনো তথ্য দেওয়া হবে না। এটা সব বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।’

রাজধানীতে তীব্র বিক্ষোভ ও সহিংসতার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল বনশ্রী। সেখানকার ফরাজী হাসপাতালের তথ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি। এ বিষয়ে তারা মহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেও মহাব্যবস্থাপক তানভীর আলমকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

এদিকে উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক জানান, তিনি হাসপাতালে ১৮ জুলাই ৭ জন এবং ১৯ জুলাই দুজনকে মারা যেতে দেখেছেন। কাউকে প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

সরকারি হাসপাতালগুলো তথ্য দিলেও আছে বিভ্রান্তি

আন্দোলন চলাকালে সহিংসতায় আহত-নিহতের তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালের চিত্র ছিল একটু ভিন্ন।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক শফিউর রহমান জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গত ১৬ জুলাই থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫১৮ জন। এর মধ্যে ৬৫ জনকে ভর্তি করতে হয়।

৩০ জনের বড় এবং ১৫০ জনের ছোট অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল বলে জানান তিনি।

শফিউর রহমান জানান, হাসপাতালে আনার আগেই ১৩ জনের মৃত্যু হয়। নিহতদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী এবং তাদের শরীরে গুলির আঘাত ছিল।

তিনি আরও জানান, অস্ত্রোপচার ওয়ার্ডে আরও রোগী ভর্তি হচ্ছে। জটিল রোগীদের জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে (এনআইসিভিডি) রেফার করা হয়।

হাসপাতালের চারতলা সার্জারি ওয়ার্ডে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। এমনকি সাংবাদিকদের পরিদর্শনের অনুমতিও দেওয়া হয়।

সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছিল আন্দোলন চলাকালে সহিংসতায় আহত আকাশ (২৫)। তিনি জানা, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের সামনে দিয়ে হাঁটার সময় একাধিক রাবার বুলেট এসে তার গায়ে লাগে। মেরুদণ্ডের নিচের মাংসপেশি থেকে ১৩টি ছররা বের করতে হয়েছে।

একই ওয়ার্ডে ভর্তি অবস্থায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির ১১ বছরের ছাত্র কাওসার। উত্তরার আবদুল্লাহপুরের একটি মহল্লায় দুই-তিনজন বন্ধুর সঙ্গে খেলছিল কাওসার। এমন সময় হঠাৎ আঘাতে ফেটে যায় তার কিডনি।

কাওসার বলেন, আমরা তো বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *