পয়লা জুলাই থেকে পাঁচ আগস্ট। ৩৬টি দিন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণঅভ্যুত্থান। ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে এই ৩৬ দিনেই চুর চুর হয়ে গেছে একটানা ১৫ বছর ধরে চলা আওয়ামী স্বৈরশাসনের। ‘অহংকার পতনের মূল’ এই নীতি বাক্যকে সঠিক প্রমাণ করে দিয়ে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে দলটির সাজানো সাম্রাজ্য। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
৩৬ দিনের এ ঘটনাপ্রবাহে ঝরে গেছে অনেক অমূল্য প্রাণ। আহত হয়ে এখনো হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন অনেকেই। কোন গন্তব্যে ছুটছে বাংলাদেশ? জাগছে এই প্রশ্নও। আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে জুনের ৫ তারিখে। এদিন ২০১৮ সালের জারি করা কোটা বাতিলের পরিপত্রের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাই কোর্ট। পরদিন আদালতের এই রায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভে নামেন শিক্ষার্থীরা।
এরপর মূল আন্দোলন শুরু হয় ১ জুলাই। ব্যাপক আন্দোলনের সূচনা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে। বিক্ষোভ হয় ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে ঘোষণা করা হয় তিন দিনের কর্মসূচি।
৭ জুলাই সারা দেশে পালিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। ব্যাপক বিক্ষোভে অচল হয়ে পড়ে রাজধানী। পরের দিনও ঘোষণা দেওয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’ এর। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১০ জুলাই কোটা পুনর্বহাল করে হাই কোর্টের আদেশের ওপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারি করা হয়। ৭ আগস্ট নির্ধারণ করা হয় পরবর্তী শুনানির তারিখ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনের এক বিতর্কিত বক্তব্য থেকে। এদিন কোটা পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়ে হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলা ‘রাজাকার’ শব্দটির জের ধরে রাতে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। শেখ হাসিনাকে প্রথম বারের মতো প্রকাশ্য রাজপথে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। পরদিন ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগসহ সরকার সমর্থকরা। ১৬ জুলাই আপিল বিভাগে দায়ের করা হয় লিভ টু আপিল। সড়ক অবরোধ, সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে এবং ছয়জনের প্রাণহানি হয়। রংপুরে পুলিশের ‘গুলিতে’ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহতের ঘটনার ভিডিও প্রকাশ পায়। পরে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধের ঘোষণা আসে।
১৭ জুলাই আগের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের বের করে দিয়ে কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাজা করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এদিন বিক্ষোভের কেন্দ্র ছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। শীর্ষ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান তিনি।
১৮ জুলাই দেশব্যাপী সংঘাত সহিংসতার ঘটনা ঘটে। রাত ৯টা থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট সংযোগ। ১৯ জুলাই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ, পরিস্থিতি থমথমে। মেট্রোরেল স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় সর্বক্ষেত্রে চলা স্থবিরতার মধ্যে রাত ১২টা থেকে জারি করা হয় কারফিউ। সারা দেশে সংঘর্ষে অন্তত ৫৬ জন নিহত হয়। প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া’, দুই মন্ত্রীর পদত্যাগসহ নয় দফা দাবি দিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
কোটা নিয়ে আপিল বিভাগের শুনানি, কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাই কোর্টের রায় বাতিল ঘোষণা করা হয় ২১ জুলাই। মেধা ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটা ১ শতাংশ নির্ধারণের আদেশ। তবে সরকার চাইলে বদলানোর সুযোগ রাখা হয়। পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর ২৩ জুলাই রাতে অগ্রাধিকার বিবেচনা করে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা ফেরে। পরদিন রাতে সারা দেশে বাসাবাড়িতেও ব্রন্ডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা সচল হয়। ২৬ জুলাই ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে রাষ্ট্রীয়ভাবে সারা দেশে শোক পালন করা হয় ৩০ জুলাই। সেই কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করে ফেসবুক প্রোফাইল লাল করার এবং চোখে কালো কাপড় বেঁধে ছবি পোস্ট করার আহ্বান জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরদিন আন্দোলনে হত্যার বিচার দাবিতে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন।
১ আগস্ট ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্তি পান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক। নিহতদের স্মরণে পালিত হয় ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি। কোটা আন্দোলনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য জামায়াত-শিবির ও এর অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ৩ আগস্ট আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাদের জন্য গণভবনের দরজা খোলা। কিন্তু সংলাপের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনকারীরা। অবশেষে বিজয়ের দিন ৫ আগস্ট। এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে ঢাকামুখী হন বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতা। উদ্দেশ্য গণভবন। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার উৎখাত। আন্দোলনের চূড়ান্ত এই দিনে পদত্যাগ করে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন বলে খবর আসে। দেশ পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হবে বলে জানান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। ঢাকার পথে পথে শুরু হয় উৎসব। চলে আনন্দ মিছিল। গণভবনের দখল নেয় জনতা। নিয়ে যায় বিভিন্ন জিনিসপত্র। শেষ হয় ৩৬ দিন ধরে চলা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বিজয়গাথা। স্বৈরশাসনের নাগপাশ ছিন্ন করে অভ্যুদয় ঘটে এক নতুন দিনের বাংলাদেশ গড়ার পথে নতুন এক যাত্রা।