দুর্নীতির অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ স্কাউট : পর্ব -১

দুর্নীতি

বঙ্গ সংবাদ রিপোর্ট :
দুর্নীতি কাকে বলে, কিভাবে করতে হয় এবং কতটা চাতুরীপূর্ণ কৌশল নিতে হয় তা শিখতে হলে বাংলাদেশ স্কাউটের কাযর্ক্রমের ওপর চোখ রাখতেই হবে। নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির কারনে সম্প্রতি বাংলাদেশ স্কাউট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে । ঢাকার কাকড়াইল নাইটাঙ্গেল মোড়ে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটি নানা অনিয়মে জর্জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন অনেকেই।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছেন, সম্প্রতি পালিয়ে যাওয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার ড.মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক বাংলাদেশে স্কাউটের সভাপতি ছিলেন। পালিয়ে যাওয়ার পরই তার বিরুদ্ধে শতাধিক কোটি টাকার লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। তার দোসর বাংলাদেশ স্কাউটের পরিচালক রুহুল আমীনের বিরুদ্ধে উঠেছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি করার।

অভিনব অবৈধ পন্থা আর প্রমানবিহীন ঘুষের লেনদেনে মাফিয়া হয়ে উঠেছে রুহুল আমিন। যিনি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বা কাব স্কাউটের একটি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বঙ্গ সংবাদের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ২০২৩ সালের শেষ দিকে এসে উপ সহকারী স্থপতি পদের বিপরীতে বাংলাদেশ স্কাউট একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করে। ওই পদে যোগ্যতা হিসেবে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন আর্কিটেক্ট ডিগ্রি ধারী হতে হবে। শিক্ষা জীবনে তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেনী গ্রহনযোগ্য নয়। গ্রেডিং সিস্টেম উত্তীর্ণ প্রার্থীর অবশ্যই ৫.০ স্কেলে কমপক্ষে সিজিপিএ ৩.৫/৪.৫ স্কেলে ৩.০ থাকতে হবে। বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে কমপক্ষে দুই বছর। এই নিয়োগের মূল যে ক্রাইটেরিয়া তা হলো এই পদটি হবে ১০ম গ্রেডের এবং বয়স হবে সর্বোচ্চ ৩০ বছর। এই বয়সকে কেন্দ্র করেই বড় ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে প্রকল্প পরিচালক রুহুল আমিন।
বঙ্গ সংবাদের এই প্রতিবেদক অনুসন্ধান করে দেখেছেন যে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ স্কাউটের নির্বাহী পরিচালকের স্বাক্ষরে দেওয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আলোকে এই উপসহকারী স্থপতি পদটিতে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেই এমাজ উদ্দিন তালুকদার ২০২০ সাল থেকে কাব স্কাউটের প্রকল্পে আউট সোর্সিং কোম্পানির কর্মচারি হিসেবে কাজ করেছেন। মূলত এই এমাজ উদ্দিনকে চাকরী দেওয়ার জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অভিজ্ঞতার শর্তাবলীতে এমন কিছু শর্ত যুক্ত করা হয় যা অন্য প্রার্থীদের থাকার কথা নয়।
যেমন পুরো শিক্ষা জীবনে তৃতীয় শ্রেনী কোনো ভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। প্রশ্ন হচ্ছে পরীক্ষায় পাশের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক নিয়মে যদি তৃতীয় শ্রেনী বা বিভাগ রাখা হয় তাহলে কেনো তৃতীয় শ্রেণী গ্রহনযোগ্য হবে না। একজন শিক্ষার্থীর নাগরিক অধিকার হিসেবে শিক্ষা জীবনে প্রতিটি ধাপে পাশ করলেই তাকে চাকরীর জন্য আবেদন করার সুযোগ দিতে হবে। এটা একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার।

সেন্টার ফর ল’ অ্যান্ড পলিসি এ্যাফেয়ার্সের পরিচালক এ্যাডভোকেট মাহবুবুল আলম বলেছেন, শিক্ষা জীবনে যেমন এসএসসি, এইচএসসি , ডিগ্রি, অনার্স অথবা মাস্টার্স পরীক্ষায় কোনো না কোনো কারনে একজন শিক্ষার্থীর তৃতীয় শ্রেনী বা বিভাগে উত্তীর্ন হওয়ার রেকর্ড থাকতে পারে। কিন্তু সেটা পুরো শিক্ষাজীবনের রেকর্ডে প্রভাব ফেলতে পারেনা। যদি এমনই হতো তাহলে পরীক্ষায় পাসের ক্ষেত্রে আইন ও বিধি অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেনী রাখা হতো না। কোনো প্রার্থী এই বিষয়টিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করলে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল হয়ে যাবে।

অ্যাডভোকেট মাহবুবুল আলম বলেন, বাংলাদেশ স্কাউটের এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অবৈধ হবে, কারন এতে একজন শিক্ষার্থীর অধিকার হরণ করা হয়েছে। সাংবিধানিক আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

If you do not see any recruitment notice, please remove the Ad Blocker from your device
এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ক,খ, গ এই তিনটি পয়েন্টে এমন কিছু অভিজ্ঞতার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে যা বিশেষ একজন প্রার্থী ছাড়া অনেকেরই পূরণ করা সম্ভব নয়।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মূল শর্ত ছিল বয়স হতে হবে ৩০ বছর। কিন্তু এই বিষয়টি উপ সহকারী স্থপতি পদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই পদে নিয়োগ পাওয়ার সময় এমাজ উদ্দিন তালুকদারের বয়স ছিল ৩৫ বছর ৩ মাসের বেশি। প্রশ্ন উঠেছে কিভাবে এমাজ উদ্দিনের বয়স শিথীল করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কেনো লঙ্ঘন করা হলো নিয়ম।
বঙ্গ সংবাদের প্রতিবেদক ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটার শর্তগুলো দেখেছেন। এর ৪ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ স্কাউটের চাকুরীতে/প্রকল্পে নিয়োজিত রয়েছেন এরূপ বিভাগীয় প্রার্থীর ক্ষেত্রে বয়সসীমা শিথিল যোগ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এই ৪ নম্বর শর্তের বিশ্লেষণ হচ্ছে, বাংলাদেশ স্কাউটে চাকরী করেন, বাংলাদেশ স্কাউট থেকেই তার বেতন ভাতা প্রদান করা হয় এমন কর্মচারি যদি প্রকল্পের কোনো পদে দায়িত্ব পালন করেন তাহলে তিনি বিভাগীয় প্রার্থী হবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছেন, এমাজ উদ্দিন তালুকদার কোনো দিনই বাংলাদেশ স্কাউটের কর্মচারি ছিলেন না। তিনি কাব স্কাউটের ৪র্থ পর্যায়ের প্রকল্পে আউটসোর্সিং কোম্পানী এমডিএসসি’র কর্মচারি হিসেবে কাজ করেছেন। তার বেতন ওই এমডিএসসি আউট সোর্সিং কোম্পনি থেকেই প্রদান করা হতো। যে কারনে তিনি কোনো ভাবেই বাংলাদেশ স্কাউটের বিভাগীয় প্রার্থী হতে পারেন না। তার বয়স শিথিলযোগ্য হতে পারে না। এক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালক রুহুল আমীন এবং নির্বাহি পরিচালক উনু চিং বড় ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন।


মি.এমাজ উদ্দিন কিভাবে বয়স শিথীল করলেন এমন একটি প্রশ্ন তাকে করেছিলেন বঙ্গ সংবাদের এই প্রতিবেদক । তিনি বলেছেন, ২০২০ সালে তিনি বাংলাদেশ স্কাউটের এক সার্কুলারে একই পদে ওই কাব স্কাউটের ৪র্থ পর্যায়ের প্রকল্পে চাকরী পেয়েছিলেন। কিন্তু যোগদানের আগেই সেই চাকরী বাতিল হয়ে যায়। তারপর প্রকল্প পরিচালক দ্রুত আউট সোর্সি কোম্পানি এমডিএসসি’র কর্মচারি হিসেবে তাকে নিয়োগ দেন।
মি. এমাজ উদ্দিন বঙ্গ সংবাদকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ স্কাউট ২০২০সালে যে নিয়োগ দিয়েছিলেন তা মন্ত্রনালয় বাতিল করে দেয়। তিনি শুনেছেন, তখন এই প্রকল্পে মন্ত্রনালয় আউট সোর্সিং কোম্পানির মাধ্যমে লোক নিয়োগ দেওয়ার নিদের্শনা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ স্কাউট লোক নিয়োগ দেওয়ায় তা মন্ত্রনালয়ই বাতিল করে দেয়। এজন্য তিনি আউট সোর্সিং কোম্পানির মাধ্যমে চাকরীতে যোগদেন।


মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশ স্কাউট নিজেদের মতো লোক নিয়োগ দেওয়ার কারনে প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রনালয় সেই সময় সব নিয়োগ বাতিল করে দেয়। যেহেতু প্রকল্পটি প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেহেতু তাদের নির্দেশনাই মানার কথা ছিল কিন্তু প্রকল্প পরিচালক রুহুল আমীন সেই নির্দেশনা মানেননি। মি. এমাজ উদ্দিন তালুকদারকে রাতারাতি একটি কাগজে কলমে তৈরি করা আউট সোর্সিং কোম্পানির কর্মচারি দেখিয়ে ওই প্রকল্পে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি বেশ রহস্যজনক। প্রশ্ন উঠেছে , এমাজ উদ্দিনের প্রথম নিয়োগ যদি মন্ত্রনালয় বাতিল করে এবং তিনি যদি প্রকল্পে আউট সোর্সিং কোম্পানি কর্মচারি হিসেবে কাজ করে থাকেন তাহলে তিনি কিভাবে বাংলাদেশ স্কাউটের বিভাগীয় কর্মচারি হলেন। কিভাবে তার বয়স শিথিলযোগ্য করা হলো। তিনি ছাড়া এই নিয়োগ পরীক্ষায় আর কতজন প্রার্থী অংশ গ্রহন করেছিল। এমন সব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি প্রকল্প পরিচালকের দফতর থেকে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যে, কেনো এবং কিসের স্বার্থে এমাজ উদ্দিনের নিয়োগে এতো নিয়ম ভঙ্গ করা হলো।

অনিয়ম আর চাতুর্যপূর্ণ এই নিয়োগে প্রকল্প পরিচালক রুহুল আমিন ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে একটি গুঞ্জন রয়েছে বাংলাদেশ স্কাউটে। যেহেতু ঘুষ প্রদানের কোনো প্রমান রাখা হয় না সেই কারনে ঘুষ লেনদেনের সময়কালের কোনো তথ্য প্রমান বঙ্গ সংবাদের হাতে নেই। তবে প্রকল্প পরিচালক রুহুল আমীন এমন একটি বড় আবাসন প্রকল্পে প্রায় কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন এমন একটি সঠিক তথ্য বঙ্গ সংবাদের হাতে রয়েছে।
এদিকে রাতারাতি কাগজে কলমে যে এমডিএসসি আউট সোর্সিং কোম্পানি তৈরি করা হয়েছে তার অনুসন্ধান চালাচ্ছেন দৈনিক বঙ্গ সংবাদ । ওই আউটসোর্সিং কোম্পানির মালিক কে , কোথায় অফিস, সরকারি নিবন্ধন রয়েছে কি না, ট্রেড লাইসেন্স আছে কি না সেই বিষয়টির খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কিছু তথ্য ইতিমধ্যে বঙ্গ সংবাদের হাতে এসেছে। আগামীতে এই আউটসোর্সিং কোম্পানির বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে মি. এমাজ উদ্দিন তালুকদার বঙ্গ সংবাদকে জানিয়েছেন, তিনি চাকরী পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ঘুষ প্রদান করেননি। কেউ যদি এটা বলে তাহলে তা মিথ্যা। একই ধরনের কথা বলেছেন, প্রকল্প পরিচালক রুহুল আমীন। তিনি জানিয়েছেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষ গ্রহনের অভিযোগটি অসত্য। বাংলাদেশ স্কাউটের মধ্যে কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *