ডিএনসিসি মেয়র আতিকের ভুয়া ভাউচারে দুর্নীতি

জাতীয়

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার এক দিন আগেই আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)-এর সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। তারপর গোপন নথিপত্র সরিয়ে নিতে ১৮ আগস্ট রাতে চুপিসারে ঢুকেছিলেন নগর ভবনে। কিন্তু দ্রুত ঘটনাটি জানাজানি হলে কর্মচারীরা জড়ো হন নগর ভবনে। শুরু করেন বিক্ষোভ। উপায়ান্তর না দেখে পালিয়ে যান পেছনের দরজা দিয়ে।

এর পরই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ডিএনসিসির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম ও তাঁর সিন্ডিকেটের দুর্নীতির খবর। পলাতক মেয়রের বিরুদ্ধে উঠেছে কয়েক শ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ। মেয়েকে হিট অফিসার, ভাতিজাকে উপদেষ্টা ও ভাগনেকে দিয়ে কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের সিন্ডিকেট বানিয়ে ডিএনসিসিতে মেয়র আতিক গড়ে তুলেছিলেন লুটপাটের রাজত্ব। ভাগনে তৌফিক পরিচিত ছিলেন সেকেন্ড মেয়র হিসেবে। করপোরেশনের কাউন্সিলর বা কর্মকর্তা না হয়েও আন্তবিভাগীয় সভায় উপস্থিত থেকে কর্মকর্তাদের শাসাতেন তিনি। সরকারি সফরেও বিদেশ ভ্রমণ, কর্মশালায় অংশগ্রহণ ও প্রশিক্ষণ নিতেন ভাগনে। এ ছাড়া টেন্ডার ফাইল নিয়ন্ত্রণ, পছন্দের ঠিকাদারকে বিনা টেন্ডারে কাজ দেওয়াসহ তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে নানান অভিযোগ। এভাবেই টানা চার বছর চলেছে সাবেক মেয়র আতিকের অনিয়ম ও দুর্নীতি। জানা যায়, বিভিন্ন বাহানায় বানানো হতো লুটপাটের নানা প্রকল্প। এমনকি রাজনৈতিক কর্মসূচি ও শোডাউনের নামেও মেয়রের ভাতিজা ইমরান, সহকারী ব্যক্তিগত সচিব (এপিএস) ফরিদ উদ্দিন, মোরশেদসহ অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় অনেক ভুয়া বিল ভাউচারে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কয়েক শ কোটি টাকা। এসব অভিযোগ সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএনসিসির একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী বলেন, সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে জনগণের ট্যাক্স এবং সরকারের দান-অনুদানের কয়েক শ কোটি টাকা লোপাটের রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন সাবেক মেয়র আতিক ও তাঁর সহযোগীরা। তাঁরা জানান, ২০২১ সালের ২৩ অক্টোবর ‘ঠিকানা রিসোর্ট’-এ উন্নয়নমূলক কর্মকা ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কিত সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। ওই সভায় খরচ হয় ১০ লাখ টাকা। কিন্তু আতিকের এপিএস ফরিদ উদ্দিন, তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা, সংস্থাটির সচিবসহ মেয়রের সিন্ডিকেট সে বাবদ ২৯ লাখ টাকা বিল দেখিয়েছে। তখন ভুয়া এ বিল ভাউচারে স্বাক্ষর করতে রাজি না হওয়ায় জনসংযোগ কর্মকর্তা আবুল বাশার মো. তাজুল ইসলামকে হয়রানি হরা হয়। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাঁকে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। আবুল বাশার অনেক চেষ্টার পর চট্টগামের বদলি স্থগিত করে ঢাকায় শিল্প মন্ত্রণালয়ে পোস্টিং নেন। কিন্তু তাঁকে টানা তিন-চার মাস ছাড়পত্র না দিয়ে আটকে রাখা হয়। ছাড়পত্র নিতে বাধ্য হয়ে ওই বিল ভাউচারে স্বাক্ষর করতে হয় তাঁকে। এ ছাড়া পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিন ডিএনসিসির বিভিন্ন সড়কে আলোকসজ্জার মাধ্যমে প্রায় ৭০ লাখ টাকার বেশি খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন মেয়র ও তাঁর সিন্ডিকেট। একই সঙ্গে মেট্রোরেল প্রকল্পের উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন উদ্বোধন উপলক্ষে সমাবেশের আয়োজনের নামে প্রায় ৫০ লাখ টাকার খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। একইভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধানী অনুষ্ঠানের নামেও প্রায় অর্ধ কোটি টাকার বিল বানিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। কর্মকর্তারা আরও জানান, ডিএনসিসির নিজস্ব নগর ভবন এবং এতে সুন্দর সুন্দর কয়েকটি হলরুম থাকা সত্ত্বেও ডিএনসিসি কাউন্সিলর ও কর্মকর্তাদের নিয়ে ‘করপোরেশনের বোর্ড’ সভার নামে মুন্সীগঞ্জে মাওয়া রিসোর্টে সভা করে প্রায় ৬০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া নগরীতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের নামে নিজের মেয়ে বুশরাকে প্রধান হিট অফিসার নিয়োগ করেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। এর আগে ২০২২ সালের ৯ নভেম্বর মেয়র আতিকের বড় ভাই ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের ছেলে ইমরানকে মেয়রের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। হিট অফিসারের পরামর্শে নগরীর বিভিন্ন আইল্যান্ডে কিছু গাছ লাগান আর নগরবাসীকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য প্রধান প্রধান সড়কে গাড়ি থেকে ওপরের দিকে পানি ছিটানোকে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর গল্প বানানো হয়। গরমে সড়কে গাড়ি থেকে পানি ছিটানোর নামে প্রায় ২ কোটি টাকা খরচ দেখিয়ে ভুয়া বিল ভাউচারে কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। একইভাবে গুলশানে নগর ভবনের সামনে অসহায় ও ছিন্নমূল লোকজনের ইফতার এবং প্যান্ডেলের খরচ বাবদ প্রায় সোয়া কোটি টাকা খরচ দেখিয়েছেন। এর মধ্যে খাবারের বিল দেখানো হয়েছে ৪৮ লাখ টাকা। গুলশানের নগর ভবনের ষষ্ঠ তলায় বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবিসংবলিত ফেস্টুন, দেয়াল সাজানো ও অফিস সাজানোর নামে কয়েক কোটি টাকা খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন। এভাবে সাবেক এই মেয়র ও তাঁর সহযোগীরা ভুয়া ভাউচারে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

অভিযোগে আরও জানা যায়, ডিএনসিসির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের ভাগনের নিয়ন্ত্রণে ছিল করপোরেশনের প্রায় সব কাজ। ভাগনে তৌফিক রহমানকে সিটি করপোরেশনে সেকেন্ড মেয়র হিসেবে ডাকা হতো। করপোরেশনের প্রায় সব টেন্ডারসহ ছোটবড় সব কাজ ভাগনের পরামর্শে পরিচালিত হতো। এমনকি করপোরেশনের কাউন্সিলর বা কর্মকর্তা না হয়েও গত বছরের ২৪ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের কমার্শিয়াল ল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (সিএলডিপি)-এর আমন্ত্রণে ডিএনসিসির ১০ দিনের প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে অংশ নেন ভাগনে তৌফিক। বিশ্বব্যাংকের ট্রান্সফর্মিং ট্রান্সপোর্টেশনের ২০তম সম্মেলনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে গত বছরের ১৩ থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত সাবেক মেয়রের নেতৃত্বে একটি দল যুক্তরাষ্ট্রে যায়, ওই সফরেও সঙ্গী হন ভাগনে। গত ৯ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত কোরিয়া ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে নগর ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা বিনিময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল সফরেও আতিকের সঙ্গী ছিলেন তিনি। গত বছরের ১৮ থেকে ২৫ মে চীনে ওয়েস্ট বেইজড পাওয়ার প্লান্ট পরিদর্শনে সাবেক মেয়রের সঙ্গী ছিলেন তৌফিক। জানা যায়, শুধু মেয়রের ভাগনে নয়, মেয়র নিজেও করপোরেশনের নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে চিত্রকর্মের কাজ করার ছয় মাস পর টেন্ডার দেখানো, গুলশান-২ ট্রাফিক সিগন্যালে পরীক্ষামূলক এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) স্থাপনের পর টেন্ডার দেখানোর দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ ছাড়া ঐক্য ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মেয়র নিজেই। এ ঐক্য ফাউন্ডেশন ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন যৌথভাবে আগারগাঁওয়ে হলিডে মার্কেট চালু করেছে। প্রতিটি দোকান থেকে ৩ হাজার করে টাকা নেওয়া হয়। কিন্তু ওইসব টাকা ডিএনসিসির ফান্ডে জমা হয়নি। ঐক্য ফাউন্ডেশনের নামে সব টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ ছাড়া মেয়রের শ্যালিকা হুমায়রা ইসলাম শক্তি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক। এ প্রতিষ্ঠানটি দিয়েই সিটি করপোরেশনের সবুজায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। একইভাবে মেয়র আতিকের এপিএস ফরিদ উদ্দিনের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘বিডি ক্লিন’কে তিন কিস্তিতে ২২ লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান এনডিসি বলেন, ‘সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের নামে অভিযোগের বিষয়ে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। দুর্নীতি করে থাকলে মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সার্বিকভাবে কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে মন্ত্রণালয় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *