আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়েই যত আতঙ্ক। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি এ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। বিশেষ করে থানা এবং কারাগার থেকে লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদগুলো পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের হাতে রয়েছে বলে ধারণা গোয়েন্দাদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অস্ত্র-গোলাবারুদ দুর্বৃত্তদের অপরাধ কর্মকান্ডে আরও উৎসাহিত করবে। বিশেষ করে আবার অপরাধপ্রবণ মানুষের কাছে এগুলো থাকলে সেও ভয়ংকর অপরাধী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বলেন, আসলে সর্বপ্রথম কাজ হওয়া উচিত থানাগুলোকে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরিয়ে নেওয়া। নইলে জনজীবনে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে না। তখনই অস্ত্র উদ্ধারে মনোযোগ দিতে পারবে পুলিশ। লুট হওয়া এসব অস্ত্র পুলিশের দ্বারাই উদ্ধার করা সম্ভব। কারণ সারা দেশে তাদের বিস্তৃত ইন্টেলিজেন্স রয়েছে।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের দিন পর্যন্ত দেশের ৪৫০টি থানা এবং ৭০টি পুলিশের স্থাপনায় হামলা হয়। শতাধিক পুলিশ নিহত এবং সহস্রাধিক পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। লুট হয়েছে সহস্রাধিক অস্ত্র এবং বিপুল সংখ্যক গোলাবারুদ। পুলিশের গুলিতে আন্দোলনরত ছাত্র এবং সাধারণ জনতা নিহত হওয়ার প্রতিবাদে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে দেশব্যাপী এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটনার সূত্রপাত হয়।
গতকাল এ বিষয়ে পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলছিলেন, খোয়া যাওয়া অস্ত্রগুলো পুলিশই দ্রুত উদ্ধার করতে পারবে। কারণ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কারা অপরাধী এ বিষয়টি পুলিশের চেয়ে অন্য কোনো বাহিনীর কাছে তথ্য নেই। এ জন্য পুলিশকে দ্রুত তাদের কাজে ফেরানো উচিত। যদিও এখনো খোয়া যাওয়া অস্ত্র এবং গোলাবারুদের সংখ্যা ফাইনাল হয়নি। এখনো তথ্য সংগ্রহ চলমান। তারা আরও বলছিলেন, পুলিশের কাছে প্রকৃত সেবা আদায় করতে হলে তাদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার থেকে দূরে রাখতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে নতুন করেই সবকিছু ভাবা উচিত হবে সরকারের। এদিকে র্যাব-১১ এর একটি টিম গত ৫ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জ থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর মধ্যে ১টি চায়না রাইফেল (বাট ভাঙা), ১টি সিজেট পিস্তল, ২টি ম্যাগাজিন, ২০ রাউন্ড সিজেট পিস্তলের গুলি, ১টি গ্যাস গান, ৫টি গ্যাস সেল, ২১টি রাবার বুলেট, ২১টি লেড বল, ১টি এক নলাবন্দুক, ১টি রিভলবার, ১০ রাউন্ড রিভলবারের গুলি, ৪টি সাউন্ড গ্রেনেড, ৩টি হ্যান্ডকাপ, ২টি মোটরসাইকেল, ১টি ডিভিআরসহ লুট হওয়া বিভিন্ন সরকারি জিনিসপত্র উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। গত শুক্রবার রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-১১ এর একটি টিম সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকা থেকে এগুলো উদ্ধার করে। এর বাইরে গণমাধ্যমে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো বার্তায় জানানো হয়েছে, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন থানা ও কারাগার হতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাটের কিছু ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে কারও কাছে রক্ষিত এ ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ অথবা এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকলে অতি দ্রুত নিকটস্থ সেনা ক্যাম্পে জমা অথবা যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, আমরা ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লুট হয়ে যাওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধারে তৎপরতা শুরু করেছি। আমাদের আহ্বান থাকবে যারা তথ্য দেবেন তাদের নাম-পরিচয় গোপন রাখা হবে। জানা গেছে, গত ১৯ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। ছিনিয়ে নিয়ে যায় নয়জন জঙ্গিসহ ৮২৬ জন বন্দি। ৬৬টি রাইফেল, ১৯টি শটগান এবং ৮ হাজার ১৫০টি গুলি লুট করে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। পরবর্তীতে ৫০টি রাইফেল উদ্ধার করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। শেরপুর কারাগারে হামলা চালিয়ে ৫১৮ জন বন্দি ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। লুট করা হয়েছে ৬টি রাইফেল, ৩টি শটগান ৮৬৪ রাউন্ড রাইফেলের গুলি, ৩৩৬ রাউন্ড শটগানের গুলি। তবে এর মধ্যে অভিযান চালিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো একটি রাইফেল উদ্ধার করেছে। সাতক্ষীরা জেলা কারাগারে হামলা করে ৫৯৬ জন বন্দি ছিনিয়ে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। তবে এর মধ্যে ৪৫২ জন বন্দি ফেরত এসেছেন। কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০৯ জন বন্দিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। কারা সদর দপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল সুজাউর রহমান বলেন, কারাগার থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের বিষয়ে আমরা সেনাবাহিনীর সহায়তা চেয়েছি। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং গাজীপুরসহ বেশ কয়েকটি কারাগারে সেনা সদস্যদের অবস্থানের কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়েছে। আনসার সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের হামলায় তিনজন আনসার সদস্য প্রাণ হারান। তবে গত ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দায়িত্বরত দুজন আনসার সদস্য প্রাণ হারান। আনসার সদর দপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) সৈয়দ ইফতেহার আলী বলেছেন, আমরা এখনো সিজার লিস্ট করতে পারিনি। তবে আমাদের দুজন সদস্য শহীদ হয়েছেন। দুটি অস্ত্র খোয়া গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, খোয়া যাওয়া অস্ত্রগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্ধার করা প্রয়োজন। এসব আগ্নেয়াস্ত্র সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য খুবই বিপজ্জনক। এসব অস্ত্র উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনে যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নিতে পারে কর্তৃপক্ষ। তবে একই সঙ্গে পুলিশকে তাদের কাজে ফিরিয়ে আনা খুব প্রয়োজন।