জাতীয়

অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ উপেক্ষা করে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ, বাড়ি ভাড়ার অর্থ তছরুপসহ নানা অভিযোগ উপাচার্যের বিরুদ্ধে।

ব্যাপক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ উপেক্ষা করে একের পর এক অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ, সরকারি বাসভবনে সার্বক্ষণিক অবস্থান করার মন্ত্রণালয়ের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা উপেক্ষা করে মাসের পর মাস ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান ও বাড়িভাড়ার অর্থ তছরুপসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে উপাচার্য ড. দিদার উল আলমের বিরুদ্ধে ।

সূত্র জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অস্থায়ী পদে কর্মরত প্রভাষকদের স্থায়ী করার জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রদান করা হলেও প্রায় প্রতিটি বিভাগেই শিক্ষা ছুটির বিপরীতে অননুমোদিত পদে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করেন উপাচার্য, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের মে মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান নিয়োগবিধি ‘স্ট্যান্ডার্ড’ নয় বলে উল্লেখ করে নিয়োগবিধি অনুসরণ করে শিক্ষক নিয়োগের কঠোর পরবর্তী সব নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসি কর্তৃক প্রণীত নির্দেশনা প্রদান করে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের ঐ নির্দেশনা উপেক্ষা করছেন উপাচার্য। এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের লিখিত নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অননুমোদিত আরো অতিরিক্ত ৫২ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-ভাতা খাতে কেবল ইউজিসি কর্তৃক অনুমোদিত জনবলের বরাদ্দ থাকায় অননুমোদিতে পদের শিক্ষকদের বেতন প্রদান নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়, যা নিয়ে সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বাড়তি শিক্ষক নিয়োগের ফলে বাজেট ঘাটতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে সামনের মাসগুলোতে স্থায়ী ও অস্থায়ীসহ সবারই বেতন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
যেসব বিভাগে ইতিমধ্যে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক রয়েছেন, সেখানেও নিজেদের পছন্দমতো অতিরিক্ত অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

উপাচার্যের ক্ষমতার অপব্যবহার : বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে উপাচার্য সার্বক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করার কথা থাকলেও তিনি খুবই অনিয়মিত অফিস করেন, যা সমালোচিত হয়েছে, যা তার বেতন বিবরণীর ‘গেস্টহাউজের’ ভাড়া পর্যবেক্ষণ করলেই প্রমাণিত হয়। নতুন বছর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তিনি মাত্র ১১ দিন অফিস করেন । এছাড়া আরো দেখা যায়, গত ডিসেম্বরে মাত্র ৯ দিন, নভেম্বর মাসে ১২ দিন, আগস্ট থেকে অক্টোবর পুরো তিন মাসে মাত্র ৪৪ দিন অফিস করেছেন । এভাবে একদিকে গেস্টহাউজ, অন্যদিকে বাড়িভাড়া অনিয়মের পাশাপাশি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান না করে সরকারি সমস্ত নির্দেশনা উপেক্ষা করছেন।

রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য নিয়োগে স্বেচ্ছাচারিতা : রিজেন্ট বোর্ডে আইন মোতাবেক একাডেমিক কাউন্সিলে নির্বাচনের মাধ্যমে রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য নিয়োগের বিধান থাকলেও উপাচার্যের বিরুদ্ধে তা অমান্য করার অভিযোগ রয়েছে। অধিকন্তু, একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক লিখিত আপত্তি জানালেও উপাচার্য তা আমলে নেননি ।

হাইকোর্টের আদেশ-নির্দেশনাও উপেক্ষা : বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. সুবোধ কুমার সরকারকে চেয়ারম্যান পদ থেকে গত ১ নভেম্বর অপসারণ করা হয় এবং একজন সহকারী অধ্যাপককে উক্ত পদে নিয়োগ প্রদান করা হয় । ড. সরকার এই নিয়োগের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করলে হাইকোর্ট এবং পরে চেম্বার জজ বেঞ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে এবং ড. সরকারকে চেয়ারম্যান পদে ১ নভেম্বর থেকে পুনর্বহালের আদেশ দেন। আদালতের আদেশ এবং ড. সরকারের বারবার আবেদন সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ১ নভেম্বর থেকে পুনর্বহালের এখনো কোনো চিঠি দেননি ।

ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে ডিন নিয়োগে আইন লঙ্ঘন : ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে নিজের পছন্দমতো ডিন নিয়োগের লক্ষ্যে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সময়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ডিন ড. মাহবুবুর রহমানকে জ্যেষ্ঠতা প্রদান করা হয়, যাকে বেআইনি বলছেন শিক্ষকেরা। সরকারি পদোন্নতি নীতিমালা অনুসারে পূর্ববর্তী পদের জ্যেষ্ঠতা বজায় রাখার নির্দেশনা রয়েছে । ইতিপূর্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অমান্য করে ২০২১ সালে ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম হোসেনকে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে ডিন পদে নিয়োগ করা হয়। অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম ইতিমধ্যে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে উকিল নোটিশও পাঠিয়েছেন ।

অবকাঠামো উন্নয়নকার্যে স্থবিরতা : উপাচার্য ড. দিদার উল আলম ২০১৯ সালের মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এত সময় অতিবাহিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি ।
অডিট রিপোর্টে নানা অনিয়ম : ইউজিসির এক অডিট রিপোর্টে বিভিন্ন কর্মকর্তার গ্রেড পরিবর্তন, নিয়ম না মেনে কর্মচারীদের ঝুঁকি ভাতা প্রদান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন একাডেমিক কার্যক্রমে সরকারি রেটের বেশি দায়িত্ব ভাতা প্রদান, ড্রাইভারদের মোবাইল ভাতা, বিধি না মেনে ইনক্রিমেন্ট, শিক্ষকদের বই ভাতা, শিক্ষকদের গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলে বেআইনিভাবে ভর্তুকি প্রদান, ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া বেশি রেটে গেস্টহাইজ ভাড়া করাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ করা হয়েছে ইউজিসির এক অডিট রিপোর্টে।
এ বিষয়ে উপাচার্যের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। মোবাইলে এসএমএস দেওয়া হলেও কোনো জবাব মেলেনি ।

উপাচার্যের মেয়াদের শেষ মুহুর্তে তড়িগড়ি করে বিভিন্ন বিভাগে চলছে নিয়োগ কার্যক্রম:
রাষ্ট্রপতির মনোনিত ব্যক্তি ছাড়া এবং প্ল্যানিং কমিটির সদস্যদের অনুমোদন ছাড়াই নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১২টি বিভাগে তড়িগড়ি করে শিক্ষক নিয়োগের বোর্ড বসিয়েছে প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়াদের শেষ মুহুর্তে এমন তড়িগড়ি করে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলে মনে করছে শিক্ষক ও কর্মকর্তারা।

বর্তমানে নিয়োগ হচ্ছে যেসব বিভাগে তার মধ্যে পরিসংখ্যান, বিএমএস, সমাজকর্ম, শিক্ষা বিভাগ, প্রানীবিদ্যা, আইন বিভাগ, সমাজ বিজ্ঞান, ইইই, শিক্ষা প্রশাসন এবং ইনস্টিটিউট ২টি হলো আইআইটি ও আইআইএস।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিভাগের প্লানিং কমিটির সদস্য, শিক্ষক এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রফেসর ড. দিদার উল আলমের আগামী ১২ জুন উপাচার্য হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এ মুহুর্তে বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগ দেয়া অবৈধ প্রায়। কোনো প্রকার প্ল্যানিং কমিটির মিটিং ছাড়া, প্ল্যানিং কমিটির সদস্যদের মতামত ছাড়া এবং রাষ্ট্রপতির মনোনিত ব্যক্তি ছাড়াই ইতোমধ্যে ১০টি বিভাগ ও ২টি ইনিস্টিটিউটে শিক্ষক নিয়োগের বোর্ড বসানো হয়েছে। যা নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ২০০১ এর প্রথম সংবিধির ৪ ও ৬ ধার ও বিধি বহির্ভুত।

সূত্র জানায়, বিভাগগুলোর সাথে আলোচনা ছাড়া এবং রাষ্ট্রপতির মনোনিত ব্যক্তি ছাড়া মনগড়া লোকজনকে নিয়োগবোর্ডের সদস্য সাজিয়ে গত ৩০ মার্চ লোকবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। বিধি অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের শুরুর তারিখ থেকে আবেদন করার জন্য অন্তত ১৫ দিন সময় দিতে হয় প্রার্থীদের। কিন্তু ৩০ মার্চ প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রার্থীরা সময় পেয়েছে ১০দিন।
উপাচার্যের মেয়াদের মাস খানেক আগে আংশিক বাছাইবোর্ড দিয়ে একাধিক বিভাগে শিক্ষকসহ লোকবল নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিভিন্ন বিভাগের প্লানিং কমিটির সদস্যরা। তারা বলছে, কোনো প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একের পর এক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সরাসরি আইন লঙ্ঘন ও বিধি বহির্ভুত।

ইনস্টিটিউট অফ ইনফরমেশন টেকনোলজির (আইআইটি) প্ল্যানিং কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নিয়ম অনুযায়ী কোনো ইনস্টিটিউট কিংবা বিভাগের লোকবল নিয়োগ দেয়ার আগে স্ব স্ব বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির মিটিং হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো প্রকার মিটিং না ডেকে বর্তমান উপাচার্য ৩০ মার্চ তড়িগড়ি করে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। যার মেয়াদ শেষ হয় ১২ এপ্রিল। পরবর্তীতে প্ল্যানিং কমিটির দ্বিতীয় মিটিং ডাকা হয় ১৩ এপ্রিল। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আইআইটিতে কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কম্পিউটার সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পাশ করা প্রার্থীদের যোগ্য বিবেচনা করার কথা । কিন্তু দেখা গেছে বিজ্ঞপ্তির শর্ত অমান্য করে সেখানে কম্পিউটার সাইন্স এন্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রার্থীদের নেয়া হয়েছে।

সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক বলেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন, বিধি কিংবা অধ্যাদেশ কিছুই মানা হচ্ছে না। স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যদিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্য দিদার উল আলম পুরোটাই ট্রেজাজার প্রফেসর ড. নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুরের উপর ভর করে চলছে।
পরিসংখ্যান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জানান, তিনি তার বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির একজন সদস্য। অথচ তিনি জানেনই না যে, তার বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ হবে। যখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আসলো তখনই তিনি জানতে পারেন পরিসংখ্যান বিভাগে সহযোগি অধ্যাপক একজন নিয়োগ দেয়া হবে। যদি সহযোগি অধ্যাপক না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে প্রভাষক নিয়োগ দিবেন। তার ভাষ্য মতে, প্ল্যানিং কমিটির বৈঠক ছাড়া এভাবে নিয়োগ অবৈধ।

এসব বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. দিদার উল-আলমকে একাধিকবার ফোন দিলেও তাকে পাওয়া যায়নি। কখনও তার পিএস রিসিভ করেছে, কখনও ফোন রিসিভ করা হয়নি। পরে রেজিষ্ট্রোরের দায়িত্বে থাকা উপ-উপচার্যকে ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। 

Click to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

জনপ্রিয়

To Top